একটি প্রার্থিত শব্দ হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য সব লেখকের মধ্যেই সমান যন্ত্রণা। সব লেখকের মধ্যেই একজন প্রতিনিয়ত ঘা-খাওয়া হতাশায় ম্লান সাধারণ মানুষ থাকে। লেখক আমজাদ হোসেনের এবারের তৈরি মানুষটির নাম-মংলু। ছেলেবেলা থেকেই স্বজনহারা মংলু একা-নি:সঙ্গ। বাবার চেহারা কেমন ছিল, অস্পষ্ট ভাবেও মনে পড়ে না। শেষ আশ্রয়টুকু ছিল মায়ের কোল। বৃষ্টির নিঝুম রাতে, মায়ের কান্নাভরা কণ্ঠে, বেহুলা-লক্ষিন্দরের গান শুনে শুনে ঘুমিয়ে পড়তো। ভয়াবহ এক বর্ষার অন্ধকারে জল-তোলপাড় করা ঘোলাটে ব্রহ্মপুত্র, বিকট শব্দে পাড় ভাঙার সময় তার মাকেও গ্রাস করে নেয়। সেই থেকে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে তার আড়ি-জেদাজেদি। দিনরাত ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গেই সে লড়াই করে বড় হয়। এখনও গভীর রাতে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে সে কথা বলে, ঝগড়া করে, ঢিল ছোঁড়ে- কখনও কখনও আবার এই ব্রহ্মপুত্রকেই সাক্ষী মানে- কালো চকচকে মংলু ছয় ফুট লম্বা। চওড়া বুক। ছোট ছোট চোখ। ঝাঁকড়া চুল। শরীরে অসূরের শক্তি। ক্ষেত-খামারের দিন মজুর। পাঁচ ছ’জন চাষীর কাজ সে একাই করতে পারে অনায়াসে। নিশাচর প্রাণীর মতো রাতে তার চোখের জ্যোতি বাড়ে। গভীর-গভীর অন্ধকারে ঝোপঝাড় জংলা পথে, সাপের চেয়েও দ্রুত গতিতে হাঁটতে পারে। তার কোনো ভয় নেই, আছে শুধু একটা গনগনে আগুনের মতো জেদ। তা কি এই শোষিত নিষ্পেষিত অভাব-গ্রস্ত সমাজের বিরুদ্ধে? বিস্ফোরণের মতো তার এই জেদ দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে। ন’মাস যুদ্ধ করে, মুখ বোঝাই দাঁড়ি আর কাদাটে- কম্বল জড়িয়ে স্টেনগান হাতে নিয়ে যখন সে গ্রামে ফিরে আসে- হাজার হাজার মানুষ তখন মংলুকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ওঠে। কারবালার মতো এই দৃশ্য যে দেখে- সেও কাঁদে। মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে দগ্ধ করে মংলুর অনুশোচনা- যে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের দু’তলা বাড়ি গ্রেনেড ছুঁড়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিলো- আজ তারই ক্ষেত-খামারে দিন মজুরের কাজ করতে হচ্ছে তাকে। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বসে, রাতের অন্ধকারে একা একাই মংলু নি:শব্দে কাঁদে। আয়না তাকে সান্ত্বনা দেয়। আয়না সেই মেয়ে, যে শুধু মংলুকে ভালোবেসে আলোক-স্তম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকে নীরবে। চৈত্রের খরতপ্ত মধ্যাহ্নে স্বামীর পিপাসায় এক গ্লাস শীতল জল হতে চায়, তার বেশি কিছু নয়। বিষয়াশ্রয়, বিন্যাসের পরিপাট্য, নির্মাণদক্ষতা, ভাষার স্বচ্ছ ও সাবলীল গতি এবং জীবনের মূল্য বোধের প্রতি শ্রদ্ধ ও বিশ্বাস, সব কিছুকেই ঔপন্যাসিক আমজাদ হোসেন তার কলমে অপরিসীম নিপুনতায় এঁকেছেন। ধ্বংসের মুখ থেকে আত্মনির্মাণের- সংযত ভাষায় তার ঈঙ্গিত আছে। লেখক নিজেই বাংলা সাহিত্যে তার এই উপন্যাসের দীর্ঘায়ু নির্ধারণ করে দিয়েছেন।