উম্মাহর ঐক্য পথ ও পন্থা
বই: উম্মাহর ঐক্য পথ ও পন্থা মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক "তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধারণ কর এবং বিভেদ করো না। স্মরণ কর যখন তোমরা একে অন্যের শত্রু ছিলে তখন আল্লাহ তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছেন। তিনি তোমাদের অন্তরসমূহ পরস্পরে মিলিয়ে দিয়েছেন। ফলে তার অনুগ্রহে তোমরা ভাই ভাই হয়ে গেছো।" (সূরা আলে-ইমরান: ১০৩) ইসলাম তাওহীদের দ্বীন এবং ঐক্যের ধর্ম। এখানে শিরকের সুযোগ নেই এবং অনৈক্য ও বিভেদের অবকাশ নেই। ইসলামে ঐক্যের ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ- এক আল্লাহর ইবাদত, এক আল্লাহর ভয়। তাওহীদের সমাজকে ইসলাম আদেশ করে সিরাতে মুস্তাকিম ও সাবীলুল মুমিনীনের উপর একতাবদ্ধ থাকার, নিজেদের ঐক্য ও সংহতি এবং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি রক্ষা করার, ইজমা ও সাবিলুল মুমিনীনের বিরোধিতা পরিহার করার এবং এমনসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার, যা উম্মাহর একতা নষ্ট করে এবং সম্প্রীতি বিনষ্ট করে। সাবিলুল মুমিনিন থেকে বিচ্যুত হওয়া ইসলামের দৃষ্টিতে কুফর এবং পরস্পর কলহ-বিবাদে লিপ্ত হওয়া হারাম ও কবীরা গুনাহ। তাওহীদপন্থী উম্মাহর পারস্পরিক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি আল্লাহ তায়ালার অনেক বড় নেয়ামত। আর এ নেয়ামত হাসিল হবে সর্বপ্রকার 'আসাবিয়াত' থেকে মুক্ত হয়ে শুধু এবং শুধু ইসলামের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ এবং ইসলামী বিধিবিধানের আনুগত্যের দ্বারা। ঐক্যের অর্থ ঈমান ও ইসলামের সূত্রে একতাবদ্ধ থাকা। ঐক্যের ভিত্তি হবে তাওহীদ। তাওহীদ ত্যাগ করে এবং দ্বীনের মূলনীতি বিসর্জন দিয়ে কোনরূপ ঐক্য গ্রহণযোগ্য নয়। কেউ তা করলে সে আল্লাহ ও রাসুলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং তাওহীদ ও ইত্তিহাদ দুটোই তার হাতছাড়া হয়। দ্বীনের মাঝে বিভেদ সৃষ্টির অর্থ তাওহীদ বা অন্য কোনো মৌলিক বিষয় সরাসরি অস্বীকার করে কিংবা তাতে অপব্যাখ্যা করে তাওহীদের উম্মাহ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামদের মাঝে শাখাগত বিষয়ে দলিলের ভিত্তিতে যে মতপার্থক্য, তা কিছুতেই বিভেদ- বিচ্ছিন্নতা নয়। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামগণের ফিকহি মাজহাব এবং আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর হক্কানী মাশায়েখের সুলুকের তরিকা প্রকৃতপক্ষে সিরাতে মুস্তাকিমেরই ব্যাখ্যা এবং তার বিভিন্ন দিক।এ পথে শয়তান নয়, এ পথে রয়েছে ওয়ারীসে নবীর নির্দেশনা। ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি এইযে, 'মুয়ালাত' বা বন্ধুত্বের মানদণ্ড হচ্ছে ঈমান ও ইসলাম। আর 'মুআদাত' বা শত্রুতার মানদণ্ড হচ্ছে শিরক ও কুফর। যে কেউ শরীয়তের দৃষ্টিতে মুসলিম উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত সে অন্য কোন বৈশিষ্ট্য ছাড়া শুধু মুমিন ও মুসলিম হওয়ার কারণেই মুয়ালাত ও বন্ধুত্বের এবং সকল ইসলামী অধিকার পাওয়ার হক রাখে। আর যে এই মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়, অর্থাৎ যে শিরক বা কুফরে লিপ্ত (প্রত্যেক কুফর শিরকেরই বিভিন্ন প্রকার) তার সাথে বন্ধুত্ব হারাম; বরং,তা কুফরের আলামত। ঈমানী ভ্রাতৃত্বের রয়েছে অনেক দাবি। পবিত্র কোরআনে বিশেষভাবে এমন কিছু দাবি উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলো পূরণ না করার কারণে সমাজে কলহ-বিবাদ সৃষ্টি হয়। তেমনি কলহ-বিবাদ সৃষ্টি হলে এই বিষয়গুলো আরও বেশি লঙ্ঘিত হয়। অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, দ্বীনী- দুনিয়াবী মতভেদের ক্ষেত্রে একে অপরকে উপহাস ও তাচ্ছিল্য করা, গীবত করা, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া, কুধারণা পোষণ করা, কটুক্তি করা, খারাপ নামে বা মন্দ উপাধিতে ডাকা- এসব বিষয়ের চর্চা হতে থাকে।লোকেরা যেন ভুলেই যায় যে, কোরআন মাজিদে এ বিষয়গুলোকে হারাম করা হয়েছে। প্রত্যেকের আচরণ থেকে মনে হয়, প্রতিপক্ষের ইজ্জত-আব্রু নষ্ট করা হালাল! মতভেদের কারণে তার কোন ঈমানি অধিকার অবশিষ্ট নেই। অথচ এ তো শুধু মুমিনের হক নয়, সাধারণ অবস্থায় মানুষমাত্রেরই হক। একজন মানুষ অপর একজন মানুষের কাছে এই নিরাপত্তা টুকু পাওয়ার অধিকার রাখে। এমনকি যদি সে মুসলিমও না হয়। হায়! বিরোধ ও মতভেদের ক্ষেত্রে যদি আমরা প্রতিপক্ষকে অন্তত একজন মানুষ মনে করে তার গীবত- শেকায়েত থেকে, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া থেকে, উপহাস বিদ্রুপ করা থেকে এবং মন্দ নামে ডাকা থেকে বিরত থাকতাম! আল্লাহর রাসূলের সুন্নাহয় তো জীবজন্তু, এমনকি জড় বস্তুরও অধিকার বর্ণিত হয়েছে। তো মতভেদকারী আর কিছু না হোক একজন প্রাণি তো বটে!! প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ঢাকার মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার আমিনুত তালিম শায়খ আব্দুল মালিক হাফিজাহুল্লাহ এভাবেই হৃদয়ের আকুতি আর দলিল-প্রমাণের আলোকে গ্রন্থটিকে সাজিয়েছেন। স্পষ্ট করেছেন ঐক্য ও অনৈক্যের মৌলিক নীতিমালা ও মানদণ্ড। পার্থক্য করেছেন বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা ও মতভেদকে। নিরসন করেছেন অনেক বিভ্রান্তির। অনেক অভিযোগ-আপত্তিরও মনোমুগ্ধকর উত্তর দিয়েছেন