সব শিল্পী কলমের অধিকারী নন। মুর্তজা বশীর ব্যতিক্রম। তিনি শুধু সুনিপুণ শিল্পী নন, সার্থক লেখকও। ইতিপূর্বে প্রকাশিত তাঁর গল্প পড়ে আমরা বিমুগ্ধ হয়েছি। কবিতায়ও তিনি রেখেছেন স্বাক্ষর। এমন দ্বৈত প্রতিভা কদাচিৎ দেখা যায়। আলট্রামেরীন যে এক সচেতন শিল্পীর রচনা তা পড়লেই বুঝতে পারা যায়। ... বশীরের ভাষা আর রচনাশৈলী চমৎকার। তাই সুখপাঠ্য কৈশোরিক জীবনের নানা স্বপ্নকল্পনার বিচিত্র রঙে রঙিন বইটির আলট্রামেরীন নাম বেমানান হয়নি... -আবুল ফজল, ইত্তেফাক, জুলাই ১৯৮০ ... এই উপন্যাসের যে অন্যতম সৌন্দর্য-সংলাপ, তার অনেকটাই নায়িকার এবং এই সংলাপ গুণেই নায়িকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অনাত্মীয় কিন্তু ঘণিষ্ঠ দু’টি নর-নারীর সংলাপ যে কতো চমকপ্রদ, আকর্ষণীয় এবং মাধুর্যমন্ডিত হতে পারে তা এ উপন্যাস পড়লে বোঝা যায়। উপন্যাসে চরিত্রগুলোর ভূমিকা সংক্ষিপ্ত এবং কেউ কেউ মূল কাহিনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়। তবু তারা সার্থক এই জন্য যে সংক্ষিপ্ত পরিসরেও তারা জীবন্ত হয়ে উঠেছে এবং তারা পরোক্ষ হলেও প্রধান দু’টি চরিত্রের পটভূমি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। ... যে আন্তরিকতা এবং পরিশ্রম তার ছবিতে বৈশিষ্ট্য এনে তাকে স্বাতন্ত্রতায় প্রতিষ্ঠিত করেছে তার পরিচয় এই উপনাসেও পাওয়া যায়।
মুর্তজা বশীর
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র কনিষ্ঠ সন্তান মুর্তজা বশীর (জন্ম ১৯৩২)। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় গভর্নমেন্ট ইন্সটিটিউট অফ আটর্স্ (বর্তমানে চারুকলা ইন্সটিটিউট) থেকে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ ম্যুজিয়ম থেকে টিচার্স ট্রেনিং সার্টিফিকেট (আর্ট এ্যাপ্রিসিয়েশন) লাভ করেন। ১৯৫৬-৫৮ সালে ইতালীর ফ্লোরেন্সে একাদেমী দ্যেল বেল্লে আরটিতে চিত্রকলা ও দেয়াল চিত্র বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৭১-৭৩ সালে প্যারিসের ইকোলে ন্যাশিওনাল সুপিরিয়্যর দ্য বোজার্ট ও আকাদেমী গোয়েৎস-এ মোজাইক ও ছাপচিত্র বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আমন্ত্রণে একমাসের জন্য আমেরিকায় আটটি ষ্টেটের বিভিন্ন ম্যুজিয়ম পরিদর্শন করেন। ১৯৬৩ সালে উর্দু চলচ্চিত্র কারোয়াঁর কাহিনী ও চিত্রনাট্য এবং ১৯৬৪ সালে নদী ও নারী চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা ও শিল্প নির্দেশনা করেন। ১৯৭৯ সালে তাঁর উপন্যাস আলট্রামেরীন এবং ২০০১ সালে নির্বাচিত রচনাবলী নিয়ে মুর্তজা বশীর: মূর্ত ও বিমূর্ত শীর্ষক গ্রন্থ প্রকাশ হয়। ১৯৮৯-৯৩ বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নাল অফ্ দ্য নিউমিসম্যাটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়াতে প্রাক-মুঘল যুগে বাংলার সুলতানদের শাসন আমলে প্রচলিত মুদ্রা বিষয় গবেষণাধর্মী একাধিক মূল্যবান নিবন্ধ প্রকাশ করেন। ১৯৮৭ সালে ব্রিটিশ কাউন্সিল ফেলোশীপে দু’মাসের জন্য লন্ডনে যান এবং ১৯৮৮ সালে ভারতের আই.সি.সি.আর ফেলেশীপে দিল্লী, বেনারস ও কলকাতার বিভিন্ন জাদুঘরে ‘বাংলা চিত্রকলার ঐতিহ্য’-এর ওপর গবেষণা করেন। ১৯৯৩ ও ১৯৯৫-১৯৯৬ সালে পুনরায় আই.সি.সি.আর-এর অনুদানের ‘মন্দির টেরাকোটা শিল্প’-এর ওপর পশ্চিম বঙ্গের প্রায় তিনশত গ্রামে সরজমিনে পর্যবেক্ষণ করার জন্য মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান করেন। চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার এবং ১৯৮০ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন এবং ১৯৯৮ সালে প্রফেসররূপে অবসর গ্রহণ করেন।