“তৃষ্ণা”বইটির প্রথম দিকের কিছু কথাঃ
একটি সুন্দর সকাল।
বুড়াে রাত বিদায় নেবার আগে বৃষ্টি থেমে গেছে। তবু তার শেষ চিহ্নটুকু এখানে-সেখানে ছড়ানাে। চিকন ঘাসের ডগায় দু-একটি পানির ফোঁটা সূর্যের সােনালি আভায় চিকচিক করছে। চারপাশে রবিশস্যের ক্ষেত। হলদে ফুলে ভরা। তারপর এক পূর্ণ-যৌবনা নদী। ওপারে তার কাশবন। এপারে অসংখ্য খড়ের গাদা।
ছেলেটির বুকে মুখ রেখে খড়ের কোলে দেহটা এলিয়ে দিয়ে ; মেয়েটি ঘুমােচ্ছে। ওর মুখে কোনাে অভিব্যক্তি নেই। ঠোটের শেষ সীমানায় শুধু একটুখানি হাসি চিবুকের কাছে এসে হারিয়ে গেছে। ওর হাত ছেলেটির হাতের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রাখা। দুজনে ঘুমােচ্ছে ওরা। ছেলেটিও ঘুমিয়ে ।
তার মুখে দীর্ঘপথ চলার ক্লান্তি। মনে হয় অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছিলাে ওরা। চুলের প্রান্তে এখনাে তার কিছু রেশ জড়ানাে রয়েছে। সহসা গাছের ডালে বুননাপাখির পাখা ঝাপটানাের শব্দ শােনা গেলাে। মটরশুটির ক্ষেত থেকে একটা সাদা ধবধবে খরগােশের বাচ্চা ছুটে পালিয়ে গেলাে কাছের অরণ্যের দিকে।
খড়ের কোলে জেগে উঠলাে অনেকগুলাে পায়ের ঐকতান। সমতালে এগিয়ে এলাে ওরা। যেখানে, ছেলেটি আর মেয়েটি এই পৃথিবীর অনেক চড়াই-উত্রাই আর অসংখ্য পথ মাড়িয়ে এসে অবশেষে এই স্নিগ্ধ সকালের সােনা-রােদে পরস্পরের কাছে অঙ্গীকার করেছিলাে।
ভালােবাসি। বলেছিলাে। এই রাত যদি চিরকালের মতাে এমনি থাকে, এই রাত যদি আর কোনােদিন ভাের না হয় আমি খুশি হবাে। বলেছিলাে। ওই-যে দূরের তারাগুলাে, যারা মিটিমিটি জ্বলছে তারা যদি হঠাৎ ভুল করে নিভে যেতাে, তাহলে খুব ভালাে হতাে। আমরা অন্ধকারে দুজনে দুজনকে দেখতাম।
বলেছিলাে। হয়তাে কিছুই বলেনি ওরা। শুধু শুয়েছিলাে। আঠারাে-জোড়া আইনের পা ধীরেধীরে চারপাশ থেকে এসে বৃত্তাকারে ঘিরে দাঁড়ালাে ওদের। ওরা তখনাে ঘুমুচ্ছে। তারপর। আমার কোনাে জাত নেই।
মাংসল হাতজোড়া ভেজা টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দিয়ে বুড়াে আহমদ হােসেন বললাে, আমার কোনাে জাত নেই। আমি না-হিন্দু, না-মুসলমান, না-ইহুদি, না-খৃষ্টান। আমায় জাত তুলে কেউ ডেকেছাে কি এক ঘুষিতে নাক ভেঙে দেবাে বলে দিলাম।
জহির রায়হান
জহির রায়হান : জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষা কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট ও আলিয়া মাদ্রাসায়। ফেনীর আমিরাবাদ হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করেন। তার আগেই কলকাতার বিখ্যাত নতুন সাহিত্য পত্রিকায় ‘ওদের জানিয়ে দাও শিরােনামে তার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যােগ দিয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি ও ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক জে এ কারদারের সহকারী হিসেবে। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনাে আসেনি' মুক্তিলাভ করে ১৯৬১ সালে।
ছাত্রজীবনেই তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে তার হাজার বছর ধরে উপন্যাসটির জন্য তিনি আদমজি পুরস্কার লাভ করেন। পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি ‘সঙ্গম' তাঁর হাত দিয়েই তৈরি হয়। ১৯৭০ সালে মুক্তিলাভ করে তাঁর পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া ছবিটি। এটি ছিল এদেশের প্রথম যথার্থ রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ ছবি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তৈরি করেন ‘স্টপ জেনােসাইড' ও ‘এ স্টেট ইজ বর্ন ছবি দুটো। এ সময় গঠিত বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তি পরিষদ’ এর তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি বড় ভাই শহীদ সাংবাদিকঔপন্যাসিক শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন। সাহিত্যকর্মের জন্য জহির রায়হান বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭২) ও স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯২) এবং চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় একুশে পদক লাভ করেন (১৯৭৭)।