ওরা কোনোদিন গ্রাম দেখেনি। ঢাকায় জন্ম গ্রহণ করেছে, ঢাকায় বড় হয়েছে, একক পরিবারে। ফলে ওদের জীবনের গণ্ডি বলতে বাবা-মা, বন্ধু-বান্ধবের মধ্যে সীমিত। তাই কিশোর বয়সে ওদের যেসব বিষয় জানা প্রয়োজন ছিলো সেগুলো জানা হয়নি। রকির বাবা যখন বললো গ্রাম থেকে তার তাহইতো ভাই আসবে তখন রকি আর রিতু দু’জনে হা করে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। গ্রাম থেকে তুলি এলো মিউজিক কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করতে, তার কাছ থেকে গ্রামের গল্প শুনে রকি গ্রামে যাওয়ার জন্য আগ্রহী হলো কিন' একা যাবে কীভাবে? বাবা-মা কেউ রাজি হলো না, তাদের সময় নেই। রকি তার গ্রামে যাওয়ার আগ্রহের কথা বললো তার ফ্রেন্ড টনি, জেমস আর তিথিকে। তিথি তো শুনেই আবেগ প্রবণ হয়ে পড়লো, ওয়াও। আমিও যাচ্ছি তোদের সঙ্গে। কিন' গ্রামে যেতে ওদের অনেক বাধা। জেমস বাবা-মা’র একমাত্র সন্তান বলে তারা জেমসকে যেতে দিলো না। তিথির গ্রামে যাওয়ার পথে বাধা হলো সে মেয়ে বলে। শুরু হলো তিথির হ্যাঙ্গার স্ট্রাইক। অবশেষে তারও একটা যাওয়ার উপায় বের হলো। এমনিভাবে অনেক বাধা বিঘ্ন পেরিয়ে ওরা গ্রামে গেলো। সেখানে গিয়ে পরিচিত হলো অনেক নতুন ঘটনার সাথে। মাইক্রোবাস থেকে নামতেই একটা পাঁঠা দেখে রকি আর টনির মধ্যে একজন বলতে শুরু করলো ভল্লুক, আরেকজন বললো। মাইক্রোবাস দেখে পাঁঠা জোরে দৌড়ে আসতেই রকি আর টনি দু’জনে দৌড় দিলো। ওদের এই কাণ্ড যেনো গ্রামের মানুষের মধ্যে একটা হাসি-ঠাট্টার বিষয় হলো। বিকেলে তুলি যখন রিতু আর তিথিকে মেহেদি পাতা তোলার জন্য ডাক দিলো তখন দু’জনে খুব খুশি হলো কিন' রিতু মেহেদি পাতা তোলার জন্য হাত বাড়াতেই তিথি জোরে চিৎকার করে বললো, হাত দিস্ না রিতু কাঁটা বিঁধবে। সখের বশে তিথি সন্ধ্যায় শাড়ি পরলো। আর শাড়ি পরে উঠান থেকে আঙিনায় নামতেই সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো। পরদিন এই ছয় জনের একদল এ্যাডভেঞ্চার প্রিয় কিশোর-কিশোরী গেলো ধর্মপুর ফরেস্টে, জঙ্গল দেখতে। জঙ্গলে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-পালা আর পশু-পাখির ছবি তুলতে তুলতে রকি আর তিথি পথ হারিয়ে ফেললো। তিথি ভুলে মোবাইল ফোন বাড়িতে ছেড়ে এসেছে আর ছবি তুলতে তুলতে রকির মোবাইল ফোনেও চার্জ শেষ হয়ে গেছে। দু’জনের শরীরও অনেক ক্লান্ত। এখন কীভাবে জঙ্গল থেকে বের হবে সে চিন্তায় দু’জনে অসি'র হয়ে পড়লো। রকির মাথায় একটা বুদ্ধি এলো, সে জোরে জোরে টনি, টনি বলে ডাকতে শুরু করলো কিন' জঙ্গলের অনেক গভীরে চলে আসায় ওদের ডাক টনি, তরু, তুলি, রিতুর কান পর্যন্ত পৌঁছালো না। ওরা নিরাশ হয়ে ক্লান্ত অবসন্ন দেহ নিয়ে পথে পথে ঘুরছিলো। এমনসময় জঙ্গলের পথ দিয়ে এক পাল শুয়োর দেখে দু’জনে ভয়ে কেঁপে উঠলো। ওরা এক গুচ্ছ ঘন ছোট গাছের আড়ালে লুকালো। গভীর জঙ্গলের দু’জন অপরিচিত কিশোর-কিশোরীকে দেখে শুয়োরের পালকে তাড়া করে এগিয়ে এলো ফিলীপ মারন্ডী। সে রকি আর তিথিকে আশ্বস' করলো, অভয় দিলো এবং দু’জনকে পথ দেখিয়ে জঙ্গল থেকে বের করে মাইক্রোবাসের কাছে পৌঁছে দিলো। পরদিন সন্ধ্যায় আড্ডা হলো তুলির দাদু লতিফ সাহেবের সঙ্গে। লতিফ সাহেব পঁচাত্তর বছর বয়সের একজন উচ্চ শিক্ষিত, জ্ঞান পিপাসু এবং প্রযুক্তি চিন্তা জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ। শহুরে এই চার কিশো-কিশোরী তার ফেসবুকে এ্যাকাউন্ট, ট্রেন টু ভিলেজ গ্রুপ, ব্লগে লেখা দেখে অবাক হলো। ওরা যেনো খুঁজে পেলো পচাঁত্তর বছর বয়সের এক চিরসবুজ বালককে। লতিফ সাহেবও অবাক হলেন যখন তিনি জানতে পারলেন ওরা কোনোদিন গ্রাম দেখেনি, গ্রামে ওদের কোনো আত্মীয়-স্বজনও নেই। এতদিন শেকড়ের টান, নাড়ির টান, মাটির টান বলে যে কথা তিনি বলতেন এই কিশোর-কিশোরীদের সেরকম কোনো টান নেই। ফুপা সম্পর্ক কাকে বলে ওরা জানে না তখন তিনি শুধু অবাকই হলেন না কিছুটা হতবাক হলেন। তিনি এই কিশোর-কিশোরীদের বোঝালেন এমনিভাবে গ্রামের সঙ্গে শহরের মানুষের সম্পর্ক ধীরে ধীরে ছিন্ন হচ্ছে, গ্রামের মানুষের সঙ্গে শহরের মানুষের বৈষম্য বাড়ছে। আর কয়েক প্রজন্ম পর হয়তো দেখা যাবে গ্রামের মানুষ আর শহরের মানুষ দু’টো আলাদা প্রজাতির মানুষে পরিণত হয়েছে। লতিফ সাহেব ওদের শোনালেন তার ইচ্ছার কথা, গ্রামের অপরূপ শোভা, গ্রামের মানুষের কৃষ্টি-কালচার বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য, মানুষে মানুষে এই সামাজিক বৈষম্য কমিয়ে সমাজকে সি'তিশীল করার জন্য। তিনি তাদের শোনালেন, দেশপ্রেমিক কিশোর ক্ষুদিরামের দেশ্রপ্রেমের কথা, বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা।
জিল্লুর রহমান
জিল্লুর রহমান ০১ সেপ্টেম্বর ১৯৬৮ খ্রি. দিনাজপুর জেলার বিরল উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা: মৃত: ইউনুছ আলী, মাতা: মোছা. মরিয়ম নেছা। মির্জাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর ধর্মপুর ইউ.সি দ্বিমূখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি এবং দিনাজপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিটিউট থেকে প্রথম বিভাগে ডিপ্লোমা-ইন-সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। পাশাপাশি বিরল কলেজ থেকে এইচ.এস.সি পাস করেন।
ছাত্রজীবন শেষে তিনি স্কাই টাচ এ্যাপার্টমেন্ট, বেসরকারি সংস্থা কারিতাস এবং নটরডেম কলেজে দীর্ঘ দিন কাজ করার পর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে যোগদান করেন।
লেখালেখির অভ্যাস ছাত্রজীবন থেকেই, তাঁর লেখা প্রথম কবিতা দৈনিক তিস্তা পত্রিকায় তারপর দৈনিক উত্তর বাংলাসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।