এখন ঐ বর্ণনাটাই চলুক- কালিদাসকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধতার কথা সর্বজনবিদিত। 'মেঘদূত' কিংবা 'নববর্ষা' রচনায় দেখি এক্সপিডিশানের মহীরূহ হয়ে ওঠা কালিদাসের একটার পর একটা স্তুতি করে চলেছেন কবিগুরু। তার কারণ এবং যুক্তিও তিনি উপস্থাপন করেছেন বিনয়ী গদ্যে : “কেবল আনন্দদানকে উদ্দেশ্য করিয়া কাব্যরচনা সংস্কৃতসাহিত্যে কেবল কালিদাসে প্রথম দেখা গেল। মেঘদূত তাহার এক দৃষ্টান্ত। এমন দৃষ্টান্ত সংস্কৃতসাহিত্যে বোধ করি আর নাই। যাহা আছে তাহা মেঘদুতেরই আধুনিক অনুকরণ, যথা পদাঙ্কদূত প্রভৃতি, এবং তাহাও পৌরাণিক। কুমারসম্ভব রঘুবংশ পৌরাণিক বটে, কিন্তু তাহা পুরাণ নহে, কাব্য; তাহা চিত্তবিনোদনের জন্য লিখিত, তাহার পাঠফলে স্বর্গপ্রাপ্তির প্রলোভন নাই। মদনভস্ম, রতিবিলাপ, উমার তপস্যা, কোনোটাতেই ত্বরান্বিত হইবার জন্য কোনো উপরোধ দেখি না। সকলেই যেন বলিতেছেন, গল্প থাক, এখন ঐ বর্ণনাটাই চলুক। রঘুবংশও বিচিত্র বর্ণনার উপলক্ষমাত্র। রাজশ্রোতারা যদি গল্পলোলুপ হইতেন তবে কালিদাসের লেখনী হইতে তখনকার কালের কতকগুলি চিত্র পাওয়া যাইত। হায়, অবস্তীরাজ্যে নববর্ষার দিনে উদয়ন-কথাকোবিদ গ্রামবুদ্ধেরা যে গল্প করিতেন সে-সমস্ত গেল কোথায়?” গল্প তো নিত্যলোকে ক্রমউৎপাদনশীল, যত্রতত্র বিচরণ ও বিক্রয়যোগ্যতাও তার আছে। উপস্থাপন আর বয়নকর্মটিই মূলত ডাটো করে তোলার বিষয়, যেটা সবার পক্ষে সহজসাধ্য হয়ে ওঠে না। কবি মোস্তফা মোহাম্মদ ঠিক এই জায়গাটাতে সিদ্ধি। অর্জন করেছেন। সূচসুতায় বুননে নির্মাণে এমব্রয়ডারির ক্রুশে- কাঁটায় যথাযথ শব্দযোজনায় উত্তুঙ্গু পারঙ্গমতা তাঁর কালে তাঁর চারপাশে দুর্লক্ষ। বললে গল্প মনে হতে পারে (গ্রামবুদ্ধেরা যে গল্প করিতেন সে-সমস্ত গল্প নয়), আমরা কালিদাসের সহস্রশতাব্দি পরের বাংলাভাষায় এক অনিবার্য কথাকোবিদ মোস্তফা মোহাম্মদকে আবিষ্কার করতে যাচ্ছি। তাঁর অন্তঃশীল উৎপ্রেক্ষার নির্ণায়ক চোখে নিষিক্ত হতে হতে ধৃতরাষ্ট্র এই প্রেমিক-চরাচর। ধূসর বিবর্ণতা ফেলে উর্বর হয়ে উঠছে সমস্বরে পলিফোনির বহুস্বরে, সাড়ম্বরে। কেবল অভিজ্ঞতা নয়, আবেগ দিয়েও হরকে লব-এর লাভযোগ্য করে নিতে হয়। সেখানেই কবিতার প্রাপ্তি, কবিতার সিন্ধি, কবিতার মুক্তি। কবি মোস্তফা মোহাম্মদ-এর জন্যে শুভকামনা সতত। আকমল হোসেন খোকন সম্পাদক, অর্বাচীন, বাংলা বিভাগ, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, ঢাকা।