হারুকি মুরাকামি বিশ্বসাহিত্যের বিস্ময়কর জনপ্রিয় সাহিত্যিকদের অন্যতম যিনি অনেকবার নোবেল পুরস্কারের শর্ট লিস্টে থাকার পরেও অজানা কারণে এখনো পাননি মূল্যবান পুরস্কারটি! পুরস্কার সাহিত্যের তুলাদন্ড না হলেও মহৎ সাহিত্যিকেরা সৃজনকর্ম দ্বারা ঠিকই সমীহ আদায় করে নেন বিশ্বব্যাপি। মুরাকামি বাংলাভাষি পাঠকদের কাছে ব্যাপক পরিচিত এবং উল্লেখ করার মতো তথ্য- অসামান্য খ্যাতিমান কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ যেসব বিদেশি সাহিত্যিকদের পছন্দ করতেন তাঁদের লেখার প্রসাদগুনে তৎমধ্যে হারুকি মুরাকামি অন্যতম। অনুবাদ সবসময় প্রকৃত স্বাদ না দিলেও কখনো-সখনো মহৎ অনুবাদকদের ধীমান কলমে উঠে আসে প্রায় হুবুহুবু চিত্র। পাঠককুল বিপুল আনন্দে ভুলে যান তরজমাকৃত ভাবনা এবং অনির্বচনীয় আনন্দে ইউরেকা বলে উঠেন শোকরের ডেকুরে। মুরাকামি’র ‘দা স্ট্রেঞ্জ লাইব্রেরি’র অনুবাদক জি এইচ কুন্ডু তার সৃজন-মানসে এ গ্রন্থের অনুবাদকে করে তুলছেন সুখপাঠ্য এবং ভৌগলিক দূরত্ব ভুলে গিয়ে আমরাও হয়ে উঠি মুরাকামির প্রতিবেশি! ‘লাইব্রেরিটা সবসময় ওযমন থাকে তারচেয়েও বেশী নীরব’- বাক্য দিয়েই মুরাকামি শুরু করে তাঁর ‘দা স্ট্রেঞ্জ লাইব্রেরি'। গ্রন্থটিকে নভেলা না নভেল এ তর্কে না নিয়ে আমাদেরকে মুরাকামি চমকে দেন প্রথম বাক্যেই! কথাসাহিত্যের যেকোন মহৎ সৃজনকারদের যে গুণ- পাঠককে ধরে রাখা এবং শেষপর্যন্ত টেনে নেয়া তারই ইঙ্গিত দেন লেখক। পাঠশেষে আমরা ভাবি- এটা কি হালের বিশেষিত ‘কিশোর উপন্যাস’? যদি তাই হয়, তবে কিশোর অভিধার সাথে এ-প্রশ্নটিও খুব জোরালো হয় কল্পনার বিস্তার আছে কি না? ‘মানুষ বস্তুবিশ্বে যা দেখে তার পূর্ণতার জন্যে সে বস্তুর অতিরিক্ত আরো কিছু দেখতে চায়’- এ চাওয়াকে; বিশেষ করে কিশোরদের সীমাহীন কল্পনাকে দীর্ঘতর করেন সাহিত্যিকেরাই। ‘তদুপরি, কল্পনা শক্তির বলেই মানুষ অতীতকে জানতে পারে, সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে’- এ-দেখার মাধ্যমেই রবী ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ মা’কে উদ্ধার করে ডাকাতদলকে হারিয়ে! মুরাকামি তাঁর নায়ককে পড়–য়া হিসেবে উপস্থাপন করে মূলত প্রজন্মকে ইতিবাচকতার দিকে নিয়ে আসতে চান। বালকটি- ‘ডেস্কের পেছনে বসা মোটা-সোটা একটা বই’ পড়া মেয়েটির কথা মতো ১০৭ রুম খুঁজতে থাকে। তারপরেই শুরু হয় অস্বাভাবিকতার রেশ। নির্ধারিত রুমে অবস্থান করা বুড়োটার বর্ণনা লেখকের ভাষায় - ‘বুড়োর মুখে ছোট ছোট কালো কালো দাগ। মনে হচ্ছে এক ঝাঁক মাছি মুখের উপর বসে আছে। মাথাটা টাক আর চোখে মোটা লেন্সের চশমা। মাথার টাকটা কেমন যেন অসম্পূর্ণ; মাথার দুই পাশে অল্প কিছু কুঁচকানো শাদা চুল অদ্ভুতভাবে লেপ্টে আছে। আগুনে পুড়তে থাকা একটা জঙ্গলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একটা পর্বতের মত লাগছে টাকটাকে দেখতে।’ মুরাকামি যেভাবে একজন লোককে বর্ণনা করেন তা ব্যাখ্যা না হলেও পাঠককে নিয়ে যান অন্য ভূবনে! সামনে থাকা নায়কের সাথে কিশোর পাঠকও হয়ে যায় প্রত্যক্ষদর্শি। আহা, ছোট ছোট অনুচ্ছেদ শেষে তৃঞ্জা জাগে অন্য অনুচ্ছেদটি পাঠের। নভেলার নায়কটির জন্য অপেক্ষা করে নানাবিধ পূর্ব-ভাবনাবর্হিভূত ঘটনাপুঞ্জ। অদ্ভুত লাইব্রেরির অদ্ভুত বুড়োটি বালকের চাহিদামতো তিনটি বই-ই নিয়ে আসে ভেতরের রুম থেকে। এবং লাইব্রেরির চিরায়ত নিয়ম অনুযায়ি বালক বইগুলি বগলদাবা করে দরজা-অভিমুখে রওনা হতেই বুড়োর ডাক-‘থামো বৎস্য’- আর শুরু হয়ে যায় আমাদের পরাবাস্তবতার বিস্তার। বুড়ো ইশারায় পথ দেখিয়ে বালককে নিয়ে যায় অচেনা-অন্ধকার রুমে। গোলকধাঁধাঁয় বালক অস্থির; সেইসাথে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে বালকের অধিক অস্থির হয়ে উঠি আমরা! এখানেই মুরাকামি আর অনুবাদকের সার্থকতা। রেলিং ধরে বুড়োর পিছুপিছু বালক নেমে যায় টিমটিম করে আলোজ্বালা ভেড়ামানবের রুমে, ততক্ষণে অবশ্য সন্ধ্যা! ভেড়ামানবটাও দেখার মতো- ‘ভেড়ামানবের জামার পিছনের ছোট্ট একটা লেজ লাগানো। হাঁটার সময় পেন্ডুলামের মতন এপাশ-ওপাশ দুলছে লেজটা।’ আহা, ওখানেই তো জেলখানার সেল! ভয়ানক বুড়ো ধোকা দিয়েই বলে- ‘চুপ থাকো, বোকা কোথাকার।’ বই তিনটা পড়ে শেষ করার মেয়াদ মাত্র একমাস এবং কাজটা ঠিকঠাক করতে পারলেই বালকের মুক্তি। বালকের সেলের বর্ণনা লেখক দেন এভাবেই- ‘ছোট্ট একটা সেল, তেমন কিছুই নেই ভিতরে- একটা বিছানা, একটা পড়ার ডেস্ক; বেসিন একটা আর একটা ফ্লাশ টয়লেট। বেসিনটার একপাশে টুথব্রাশ আর একটা গ্লাস রাখা।’ বালকের মনে পড়ে মায়ের কথা- যিনি সন্ধ্যা নামলেই খাবার প্রস্তুত রাখে তার জন্যে। ভেড়ামানব জানায়- ‘তার মাথাটা কেটে ফেলা হবে, ইয়াম্মি মগজটা খেয়ে ফেলবে ঠিক একমাস পর। বালক ভেড়ামানবকে কাকুতি করে মুক্তির উপায় বাতলে দিতে, কিন্তু তারও তো ভয় আছে- লোমওয়ালা শুঁয়োপোকার। বালক ঘড়ি দেখে আর ভাবে মায়ের কথা, পোষা শালিকের কথা। বুড়ো, ভেড়ামানবের পর আসে মিষ্টি একটা মেয়ে, খাবার নিয়ে। হয়তো বয়সের ফেরে দুজনেই বন্ধু হয়ে যায়। মেয়েটা কী রকম? লেখকের ভাষায়- ‘খুব হালকা পায়ে হাঁটে মেয়েটা, মে মাসের বাতাসের মতোন।’ ‘একজন অটোমান কর-সংগ্রাহকের ডায়েরী’ বইটা পড়তে পড়তে তুর্কি কর-সংগ্রাহক ইবনে আরমুত হাসির হয়ে যায় বালক। তাঁরও যে বালকের শালিকের মতো আদুরে টিয়ে ছিল! অদ্ভুত ব্যাপার বটে- ভেড়ামানব বলে কিনা- সে-ই খাবার এনেছিল! মুরাকামি ছোট ছোট অনুচ্ছেদজুড়ে এঁকে দেন কল্পনার বিস্তার, ভাবিয়ে তোলেন পাঠককে। আসলে মেয়েটির আগমনকেই সম্ভাবনারেখা করে তোলেন মুরাকামি। তাদের দুঃখগুলো যেন মিলে যায় একই বিন্দুতে! সে ভেড়ামানবকেও দলে বেড়ায়- চিন্তার সহযাত্রী করতে। তার প্ল্যান করে কীভাবে পালানো যায়! ‘অন্ধ শুশুকের মতন মাসের নতুন চাঁদের রাত নীরবে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে।’ বুড়ো সে রাতেই বালককে দেখতে এসে খুশি হয় ভীষণ। আহা, নতুন চাঁদ উঠলে যে প্রভাব পড়ে অদ্ভুত লাইব্রেরির লোকজনের উপর! মেয়েটি জানায়- এ সুযোগেই পালাতে হবে, সাথে মেয়েটি আর ভেড়ামানব। সে কি অগস্থযাত্রা! অচেনা-অন্ধকার পথ ধরে মুক্তির পথে হাঁটতে থাকে তিনজন, মাঝপথেই মিষ্টি মেয়েটি হাওয়া! হাতড়ে চলে তাদের দরজা বরাবর মিশন। কল্পনার রাজ্যে কিশোরদের নিয়ে যায় মুরাকামি। এ যাত্রা- চরম বিপদসংকুল তবুও সাহসী করে তোলে মুক্তির পথ। কখনো-সখনো কিশোরদের চরম আনন্দদানসহ অ্যাডভেনঞ্চারের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে নিয়ে যায় মুরাকামি। এলোমেলো পথযাত্রা শেষ করে ভেড়ামানব আর বালক যখন দরজার ওপারে যেতে উদ্ধত, কে জানতো তাদের জন্য অপেক্ষা করছে অস্থির-অন্ধকার! আশা নিয়ে ভেড়ামানব দরজা খুলে দেখে- ‘ওপাশে বুড়ো বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’ সেই ১০৭ রুম, সেই অভিজ্ঞতা! বড় কালো একটা কুকুরের পাশে বসা বুড়ো। কুকুর তো নয় যেন সাক্ষাৎ জল্লাদের দোসর! তাও আবার, কুকুরটার দাঁতে লেগে আছে বালকের পোষা শালিকটার রক্ত! চালাক ও ভয়ঙ্কর বুড়োটি যে আগে থেকে পড়ে আছে পালানোদের মনের কথা! পরাবাস্তবতার মিশেল এখানে আবারো দেখান মুরাকামি- কুকুরের মুখে থাকা শালিকটা ক্রমশ বড় হতে থাকে... মটমট করে কুকুরটার মুখ দু’ভাগ হয়ে গেল। পষ্ট হতে থাকে শালিকের রূপ, এতো শালিক নয়- মেয়েটা যে কিনা বালককে খাবার দিতো, গল্প করতো। আহা, মেয়েটা নিজের দিকে না দেখে, বুড়োর বেত বেত সহ্য করেই বালককে পালাতে সুযোগ করে দেয়- এখানে আমরা দেখি, মুরাকামি কিশোর বন্ধুদের সহযোগিতার মানসিকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। ভেড়ামানব নেই পাশে, মেয়েটাও নেই- দৌড় শেষে বালক নিজেকে আবিষ্কার করে পার্কের সবুজতায়। ‘বাড়ি ফিরে দেখলাম টেবিলে গরম গরম নাস্তা সাজিয়ে মা আমার জন্য অপেক্ষা করছে’- মা তো এমনই! মনেহয় মা প্রস্তুতই ছিলেন- তার ছেলে আসবে, নাস্তা রেড়ি করা দরকার। শখের জুতোজোড়া হারানোর প্রশ্ন তুলে না মা, বালক অবাক হয় এতো মায়ের সাথে যায় না! শালিকটাও নেই আর, বালক কাউকে জিজ্ঞেস করেনি কেন এমন হলো! এরপর বালক কখনো যায়নি লাইব্রেরির ও পথে- ওদিকের কাউকে কি জিজ্ঞেস করা উচিত- ওখানে কি আগের মতো বেসমেন্ট আছে? তবুও কি এক অনতিক্রম্য দূরত্বে বালক যেতে পারে লাইব্রেরির দিকে। মনে বারবার ঘুরে ভেড়ামানবের কথা, মেয়েটির কথা। আসলে সেসব কি বালকের জীবনে ঘটেছিল, না দুঃস্বপ্ন? তবুও চামড়ার জুতোজোড়া আর পোষা শালিকটি তো হারিয়ে গেলো জীবনের জন্য! এ তো সত্য বটে!! মানুষের জীবনের প্রিয় বিষয়গুলো সবসময় তো আর থাকে না, চলে যায় যার যার মতো। এ নিয়তি থেকে রেহাই পায় না বালকও। তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় তো বটেই এক মঙ্গলবার মারা যায় প্রিয় মা। পুরোপুরি একা হয়ে যায় বালক। তখনো তার মনে পড়ে সেই অদ্ভূত লাইব্রেরিটার কথা। এক জীবনের বালকবয়সের কথা কি আর ভুলা যায়? পারে না বালক, পারে না কিশোর বয়সের কেউ-ই।
হারুকি মুরাকামি
সমসাময়িক পৃথিবীর সর্বাধিক জনপ্রিয় লেখকদের মধ্যে অন্যতম হারুকি মুরাকামির জন্ম ১২ জানুয়ারি, ১৯৪৯, জাপানের কিয়ােটো শহরে। বর্তমানে টোকিওতে বসবাসরত এই লেখক এ পর্যন্ত লিখেছেন তেরােটি উপন্যাস এবং চারটি গল্পগ্রন্থ, যেগুলাে অনূদিত হয়েছে। পঞ্চাশটিরও অধিক ভাষায়। তার রচিত কথাসাহিত্য তাকে জাপান ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সমালােচকদের প্রশংসা ও অনেক পুরস্কার এনে দিয়েছে। এইসকল পুরস্কারের মধ্যে রয়েছে ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ড (২০০৬), ফ্রাংক ও’কনার আন্তর্জাতিক ছােটগল্প পুরস্কার অপরদিকে তার সমস্ত শিল্পসম্ভারের জন্য ফ্রানৎস কাফকা পুরস্কার (২০০৬) এবং জেরুজালেম পুরস্কার (২০০৯) অন্যতম।
দি গার্ডিয়েনের স্টিভেন পুল সাহিত্যকর্মের জন্য হারুকি মুরাকামিকে পৃথিবীর জীবিত সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম বলে আখ্যা দেন।
তিনি গত এক দশকে কয়েকবার সাহিত্যে নােবেল পুরস্কারের জন্য শর্ট লিস্টেড হয়েছেন।