'দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ' বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যভিত্তিক এই বইটির লেখক উপমহাদেশের বিখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেন্হাস। ১৯৭১ সালের ১৪ই এপ্রিল অ্যান্থনিসহ আরো কয়েকজন সাংবাদিক পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে ঢাকা আসেন 'পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে' এই মর্মে সংবাদ পরিবেশনের জন্য। কিন্তু, পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস বর্বরতা হতবাক করে তাঁকে,স্তম্ভিত হয়ে ভাবেন এ বর্বরতা বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার কথা। পূর্ববাংলায় পাকিস্তানিদের বর্বরতাকে তিনি হিটলার ও নাৎসীবাদের অমানুষিক বর্বরতার চেয়েও ভয়াবহ বলে বইটির ভূমিকায় লিখেছেন। তাই, তিনি এ অমানবিক নৃশংসতার চিত্র বিশ্ববাসীকে জানানোর সংকল্প নিয়ে ১৯৭১ এর মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে লন্ডনে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি সবকিছু তুলে ধরেন 'সানডে টাইমস'এ; ১৯৭১ এর ১৩ই জুন 'সানডে টাইমস' পাকিস্তানের গণহত্যার সম্পূর্ণ কাহিনী ফাঁস করে দেয়। ঐ সকল খবরের যুক্তিসংগত অনুসিদ্ধান্তই হল দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ গ্রন্থটি,যার বঙ্গানুবাদও হয়েছে 'বাংলাদেশ লাঞ্ছিতা' নামে। পরিশিষ্ট ছাড়াও বইটি মূলতঃ চৌদ্দটি অংশে বিভক্ত- ১ম অংশে তিনি বইটির প্রস্তাবনায় 'দুর্বিপাক' শিরোনামে ২৫ মার্চের কালরাত্রির প্রেক্ষাপট, হানাদারদের প্রস্তুতি ইত্যাদি তুলে ধরেছেন, এবং পাকিস্তানিদের বৈষম্যমূলক নীতিও তুলে ধরেছেন নিরপেক্ষভাবে ৪র্থ অংশে। ২য় অংশে পাকিস্তানের পতন কেন এবং তার কারনসমূহ খুজঁতে চেষ্টা করেছেন প্রাকস্বাধীনতা যুগে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি ও বিকাশ। পরিণতিতে সৃষ্ট সংঘাতের স্বরুপ, কারণ প্রভৃতিও অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা করেছেন। পরবর্তী অংশে পাকিস্তানিদের বিরাট বিশ্বাসঘাতকতার স্বরুপ উন্মোচন করেছেন। পাকিস্তান রাষ্ট্রসৃষ্টির মূলনীতির প্রতি শাসকগোষ্ঠীর বিশ্বাসঘাতকতা, গণতন্ত্রকে পদদলিত করা- এসব বিষয় তুলে ধরেছেন যুক্তির নিরিখে। এক নতুন পর্ব শীর্ষক অধ্যায়ে ইয়াহিয়া যুগের সূচনা, তার ব্যক্তিগত আচরণ, প্রতিশ্রুতি বর্ননার পাশাপাশি আরেকটি বড় বিশ্বাসঘাতকতার ইঙ্গিত দেন লেখক। পরবর্তী অংশে 'নির্বাচন-পূর্ব টালবাহানা' শিরোনামে ইয়াহিয়ার নির্বাচন-শাসনতন্ত্র সংস্কার সংক্রান্ত ভাষণের বিশ্লেষণ-তাতে বাঙ্গালির প্রতি অবহেলার চিত্র ফুটিয়ে তোলেন অ্যান্থনি। পরের অংশে নির্বাচনোত্তর প্রতারণার বিবরণ বর্ণিত হয়েছে। নির্বাচনে ১৬৭ আসন পাওয়া আওয়ামীলীগকে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা, জনরোষের উর্ধ্বগতি প্রভৃতি বিষয়ে সবিস্তৃত বর্ণনা রয়েছে। 'পাক-সামরিক বাহিনীর অভিযান' অধ্যায়ে বর্বর হানাদারদের ঢাকায় সৈন্যসমাবেশ, প্রস্তুতি ও অভিযান -বর্ণিত হয়েছে। 'পচিঁশটি স্মরনীয় দিন' অধ্যায়ে ১৯৭১ সালের মার্চের ১-২৫ তারিখ এই স্মরণীয় ২৫ দিনের ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা রয়েছে। পরবর্তী অংশে রয়েছে গণহত্যা ও পাকিস্তানিদের নিষ্ঠুরতার বিবরণ। 'গোয়েবল্সের পুনরাবির্ভাব' অধ্যায়ে পাকিস্তানি তথ্যমন্ত্রণালয়ের নির্লজ্জ অপপ্রচার ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের নিষ্ক্রিয় দর্শক ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেছেন লেখক। 'আশি লাখ লোক কেন মারা যাবে' শিরোনামের অধ্যায়ে- সত্তরের নভেম্বর হতে একাত্তরের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে দুটি বিরাট বিপর্যয়- ঘূর্ণিঝড়-জ্বলোচ্ছ্বাস, এবং পাকবাহিনীর গণহত্যায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যার প্রাচুর্য ও ব্যাপক প্রাণহানিতে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া পূর্ব পাকিস্তানের দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠেছে। সর্বশেষ অধ্যায় 'বাংলাদেশ কেন?'তে এই প্রশ্নের উত্তরে যৌক্তিক সমাধান টেনেছেন লেখক। পরিশিষ্টে রয়েছে-'বঙ্গবন্ধুর ছয়দফা', ভাষণ, ছাত্রসমাজের এগারো দফা এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এর মার্চ পর্যন্ত ঘটনাপঞ্জি। বইটিকে সমৃদ্ধ করেছে বঙ্গবন্ধুর ছবি,অ্যান্থনি ম্যাসকারেন্হাসের জীবনপরিচিতি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ 'হানাদারদের অত্যাচারের নিদর্শনস্বরুপ পেশকৃত ১১টি দুর্লভ ছবি-যা নাড়া দেয় প্রতিটি মানুষের বিবেককে, হৃদয়ে ঘটায় রক্তক্ষরণ।
অ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস
অ্যান্থনী মাসকারেণহাস (১৯২৮-'৮৬) জন্মসূত্রে ভারতীয় গােয়ানীজ খৃস্টান, বসবাস সূত্রে পাকিস্তানী। করাচীতে সাংবাদিকতা পেশায় ১৯৪৭ সনে বয়টার -এ যােগ দেন। পাকিস্তান সংবাদ সংস্থা, এপিপি এবং নিউইয়র্ক টাইমস, টাইম/লাইফ সাপ্তাহিকীর ১৯৪৯-১৯৫৪ পর্যন্ত সংবাদদাতা ছিলেন। করাচীসহ “দি মর্নিং নিউজ”এর চীপ রিপাের্টার, পরে সহ-সম্পাদক পদে ১৯৬১ সন থেকে ১৯৭১ সনের মে মাস পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। একাত্তরের এপ্রিল মাসে ঢাকা সফরকালে গণহত্যার তথ্যাদি সংগ্রহ করেন এবং বিলেতে পালিয়ে গিয়ে সানডে টাইমস (১৩ই জুন ’৭১) পত্রিকায় গণহত্যার তথ্যাদি প্রকাশ করে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে অগ্রণী ভূমিকাপালন করেন। তাছাড়া উপমহাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাবলী অন্তরঙ্গ আলােকে প্রত্যক্ষ করে সাংবাদিকের স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তা বর্ণনা করেন। দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ রক্তের ঋণ গ্রন্থ দুটি সেই আলােকেই বিচার্য। ১৯৮৬ সালের ৬ই ডিসেম্বর অ্যান্থনী মাসকারেণহাস হৃদরােগে আক্রান্ত হয়ে লন্ডনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।