দ্য কিংডম অব আউটসাইডারস
পৃথিবী নানান সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হয় বিভিন্ন দুর্যোগ ও হুমকি। কতক মানবসৃষ্ট আর কতগুলো প্রাকৃতিক। যুদ্ধ, মহামারি, দুর্ভিক্ষ, ঝড়, সুনামি আরোও কত কি। একটা শেষ হতে না হতেই শুরু হয় আরেকটা। কখনো পৃথিবীবাসীকে একইসাথে মোকাবেলা করতে হয় একাধিক দুর্যোগ ও হুমকি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ধর্ম মানে না, জাতি চেনে না, বোঝে না ধনী গরিবের পার্থক্য। এমনকি তা মহাপরাক্রমশালী রাষ্ট্রের ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্রকেও ভয় পায় না। যেখানে আসে তার সর্বগ্রাসী রূপ দেখিয়েই তবে বিদায় নেয়। সাম্প্রতিক বিশ্বব্যাপী দ্রুত ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাস সৃষ্ট কোভিড১৯ এর বড় উদাহরণ। একসময় হয়তো এর প্রকোপ শেষ হবে। পৃথিবীবাসী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে। একসময় হয়তো আবার কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসবে। ভিন্ন নামে, ভিন্ন স্থানে। এমনকি সারা পৃথিবীতে। কিন্তু মানবসৃষ্ট কিছু সংকট/ হুমকি এখনো পৃথিবীকে নাড়িয়ে যাচ্ছে প্রবলভাবে। আকাশে বাতাসে এক সময় মিলিয়ে যাচ্ছে মজলুমের আর্তচিৎকার। বাতাস ভারী হয়, আকাশ ক্রন্দন করে কিন্তু থামেনা যায়নবাদীদের দানবীয় থাবা। ইউরোপ আমেরিকা এমনকি খোদ আরব প্রতিবেশীরাও এখন ইহুদী ধর্মাশ্রয়ী কট্টর জায়োনিস্টদের দোসর। প্রকাশ্যে ও গোপনে এই দানবটিকে বাড়তে সাহায্য করা মুরুব্বীরা চোখে ঠুলি পড়ে বসে আসে। আরব ভূমিতে অবৈধভাবে গড়ে উঠা রাষ্ট্র ইসরাইল এখন পৃথবীর গলার কাঁটা। আর যমদূত হয়েছে ফিলিস্তিনের ভূমির মালিকদের। প্রায়শ মুসলিম ফিলিস্তিনিদের রক্তে সিক্ত হয় মরুর বালি। নিজ ভূমি থেকে শুধু মুসলিম ফিলিস্তিনিই নয়, উদ্বাস্তু হয়েছেন খ্রীস্টানরাও। ভূমির মালিকরা এখন বাস করে উন্মুক্ত কারাগার আর উদ্বাস্তু শিবিরে। শিকার টার্গেট কিলিংয়ের। আর নানান দেশ থেকে জড়ো হওয়া সন্ত্রাসীরাই রাষ্ট্রের মালিক। এই সন্ত্রাসী রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখতে, ফিলিস্তিনের জনগনকে স্থায়ীভাবে তাদের ভূখন্ড থেকে দূরে রাখতে সবকিছুই করতে প্রস্তুত ইসরায়েল। সামরিক, বৈজ্ঞানিক, গোয়েন্দা, প্রযুক্তি, আর্থিক এমনকি কৃষি প্রতিটা ক্ষেত্রেই তারা এতটাই এগিয়েছে যে ইসরায়েলের মুরুব্বীরা এখন তাকিয়ে থাকে এর দিকে। আর ৪ বার ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ গোহারা হারা আরবরা ক্ষমতা, গোষ্ঠীদন্দ্ব, আর ব্যক্তি-পারিবারিক বিলাস ব্যসনে এতটাই মত্ত, যে ভুলে গেছে ইতিহাস, সবকিছু। একনায়ক, রাজতান্ত্রিক শাসকেরা নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে জনগণকে ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে তৎপর। আরব রাষ্ট্র গুলো নিজেরা নিজেদের জনগণের বুকে, প্রতিবেশী আরবদের পিঠে ছুরি চালাতে দ্বিধা করে না। মজার ব্যাপার এই ছুরি আরবরা বানিয়েছে বা কিনেছে ইসরায়েলের মুরুব্বি আমেরিকা ইউরোপ থেকে। আর তাতে ধার দেয় খোদ ইসরায়েল থেকে! ১ম বিশ্বযুদ্ধে বেদখল হওয়া আরবভূমিতে তৎকালীন পরাশক্তি বৃটেন ও ফ্রান্সের সহযোগিতায় আর উঠতি নেতা আমেরিকার মদদে ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে উঠে অবৈধ ইহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। যদিওবা তারা আরোও কয়েক দশক আগেই এর ছক কষেছিল। ২য় বিশ্বযুদ্ধে ইহুূদীরা নির্যাতিত হয়েছিল ইউরোপে কিন্ত এর ভার বইতে হচ্ছে আরবদের, ফিলস্তিনিদের। জায়োনবাদীরা প্রচার করে, দুহাজার বছর আগে এ অঞ্চল থেকে বিতারিত হয় ইহুদীরা। তাই তাদের নিজ ভূমিতে তারা ফিরবে, এটা তাদের অধিকার! কী অদ্ভুত? বুঝ হবার পর থেকে এখন অব্দি টিভি বা পত্রিকায় খবর দেখছি, পড়ছি। তাতে এমন কোন দিন ছিল না যেদিন ইসরায়েলের নিরাপত্তা বাহিনী কোন ফিলিস্তিনিকে নির্যাতন করে নাই। তাদের হত্যা করে নাই, ঘরবাড়ি ধূলায় ধূলিসাৎ করে নাই, এমন দিন খুব কমই গেছে। মিডিয়াতে সব সময়ের আলোচিত ইস্যু এটি। বিভিন্ন অজুহাতে ফিলিস্তিনের ওপর খড়গহস্ত হওয়া নৈমিত্তিক ব্যাপার। কূটকৌশল আর শক্তির জোরে গড়ে উঠা অবৈধরাষ্ট্র ইসরাইলের ওপর পৃথিবীতে নানান ভাষায় প্রচুর গবেষণা, পড়ালেখা, বইপত্র, আর্টিকেল লেখা, ডকুমেন্টারি, মুভি বানানো হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় তেমন বই, গবেষণা নেই বললেই চলে। সে অভাবটি কিছুটা হলেও পূরণ করেছেন সাংবাদিক সোহেল রানা। এটি তার প্রথম বই। প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার আরেকটি সুপরিচিত প্রকাশনী গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স থেকে। বইটিতে ইহুদীদের প্রাচীন ইতিহাস থেকে শুরু করে হাল আমল পর্যন্ত বর্ণনা আছে কিন্তু তা ইতিহাসের চেয়ে গল্প আকারে। সাবলীলভাবে লেখা। কখনো মনে হয়েছে থৃলার, কখনো ইতিহাস। আছে আরব ইসরায়েল যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, আরবদের অকর্মণ্যতার নানান বিবরণ। বইটিতে ইসরায়েলের সামরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক নানা বিষয়ে শক্তিমত্তার বিবরণও উঠে এসেছে। ট্রাম্পের ডিল অব দ্যা সেঞ্চুরি থেকে হামাস ও অন্যান্য মুক্তিকামী সংগঠন, তার নেতৃত্ব ও কর্মকাণ্ডের কথাও উঠে এসেছে বইটিতে। প্রতিবেশীদের কীভাবে বাগে এনেছে, রয়েছে সে বর্ণনাও। এককথায় হাজারো তথ্যে ঠাসা ৩২০ পৃষ্ঠার এ বইটি।
" দ্য কিংডম অব আউটসাইডারস" বইটিতে লেখক ইহুদিদের পূর্বপুরুষ ইয়াকুব আ. থেকে শুরু করে বনি ইসরাইলের ইতিহাস, বিভিন্ন সময়ে ইহুদিদের নির্যাতিত হবার এবং নির্যাতন করার ইতিহাস, সর্বোপরি বেলফোর ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইহুদিবাদের উত্থানের ঐতিহাসিক- রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। সব ধর্মের মানুষকেই যে জায়োনিস্ট বলা যায় সেটা নিয়েও সুন্দর আলোচনা আছে। চারটি আরব - ইজরাইল যুদ্ধের বিশ্লেষণী উপস্থাপন, ফিলিস্তিনের রাজনীতিতে হামাস -ফাতাহর অবস্থান, অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে ইহুদিদের উত্থান, জ্ঞান বিজ্ঞানে এগিয়ে গিয়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপর প্রভাব বিস্তারের কৌশল নিয়েও আছে তথ্যবহূল আলোচনা। বিশ্বজুড়ে ইজরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, আমান, শিনবেতের বিছিয়ে দেয়া জালে আটকে পড়ে কতো আরব বিশ্বাসঘাতকতা করছে নিজের দেশের সাথে, কতো জন হচ্ছে গুপ্তহত্যার শিকার, লোমহর্ষক সেইসব সত্য ঘটনাও উঠে এসেছে বইটিতে। ইতিহাস বলে ইহুদিরা ব্যবিলনীয়, রোমানীয়, মিশরের ফারাও, খ্রিস্টান ক্রসেডারদের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছিল। নির্যাতিত হয়েছে নাজিবাদী জার্মান এমনকি রাশিয়ার জার শাসকদের দ্বারাও। কিন্তু মুসলিমদের দ্বারা ইহুদিরা জাতিগতভাবে নির্যাতিত হয়েছে এমন কোন ইতিহাস পাওয়া যায় না। অথচ হাস্যকর উত্তরাধিকারের দাবীতে আরবের বুকেই চেপে বসলো ইহুদিরা। বাস্তুহারা ফিলিস্তিনিরা যে বিনা প্রতিবাদে তাদের জায়গা ছেড়ে দিয়েছিল তাও নয়। ছোট ছোট সহস্র সংঘর্ষ ছাড়াও চার চারটি বড় ধরনের (আবর- ইজরাইল) যুদ্ধ হয়। কিন্তু কখনো সন্মুখ সমরে, কখনো কূটনৈতিক কৌশলে হেরে যেতে থাকলো আরবরা। আজও এই অসমাপ্ত যুদ্ধ চলছে, এখনও ফিলিস্তিনিদের রক্তে লাল হচ্ছে তাদের জন্মভূমি। 'আউটসাইডার' ইহুদিরা আরবের বুকে গড়ে তুললো তাদের কিংডম। ইহুদিদের এই কিংডমের ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে লেখক সোহেল রানা লিখেছেন তারা গবেষণাধর্মী বই "দ্য কিংডম অব আউটসাইডারস"।
ইহুদী জাতির ইতিহাসের চর্চা বঙ্গ তল্লাটে বহু আগে থেকেই হয়ে আসছে। ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের বুকে ইসরাইলের খুঁটি গেঁড়ে বসার ইতিহাস যবে থেকে শুরু সেই তবে থেকেই উপমহাদেশে ইহুদীদের নিয়ে চর্চা হয়েছে। তবে সেই চর্চা কেবল পত্র-পত্রিকা কিংবা হাল আমলের ইন্টারনেট মাধ্যমগুলোতে হয়েছে। মুসলমানদের চিহ্নিত শত্রু হিসেবে ঢালাওভাবে পরিচিতি পাওয়ায় বাংলার মুসলমান সমাজে এই চর্চা গুরুত্ব পেয়েছে সবচেয়ে বেশী। কিন্তু মজার ব্যপার হলো ইহুদী জাতির ইতিহাস এবং তাদের আদর্শিক কার্যক্রম নিয়ে লেখালেখির যে ধারা তা বইয়ের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়েছে যৎসামান্যই। ফলে এই দুর্ধর্ষ জাতির অবমানুষিক কার্যকলাপের আগাগোড়া, এই জাতির উত্থানের বিস্তারিত ইতিহাস কিংবা পৃথিবীর বুকে তাদের দখলদারিত্ব, সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞানমূলক আলোচনা সাধারণ মানুষের কাছে অজানাই থেকে গেছে। সেই ধারা থেকে বেরিয়ে এসে সাম্প্রতিককালের কিছু তরুণ লেখকের হাত ধরে উঠে এসে ইহুদী জাতির গোড়ার রহস্য। এমনকি একই বছরে একই বইমেলায় ইহুদী জাতি সম্পর্কিত দুতিনটির বেশী বই প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। এতে স্পষ্টতই বোঝা যায় বঙ্গসমাজে ইহুদী জাতিকে জানার ইচ্ছা তীব্রতর হয়েছে। একজন সাধারণ বঙ্গবাসী বইপাঠক হিসেবে আমি নিজেও এই কৌতূহলের বাইরে থেকে যেতে পারিনি। বিশেষ করে যখন বিশ্ব-রাজনীতি সম্পর্কে জানতে শুরু করেছি, তখন সময়ের পরিক্রমায় এর গভীর থেকে গভীরে পরিভ্রমণের ইচ্ছা আরও বেশী তৃষিত হয়েছে। আর বিশ্ব রাজনীতির বাঁকে বাঁকে ইহুদী জাতি তথা ইজরায়েলের বিচরণ যে সারা বিশ্বের সমস্ত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এবং সামাজিক ব্যবস্থার বিশাল অনশকে নিয়ন্ত্রণ করছে, তার গোপন রহস্য ভেদ করতে হলে ইহুদী জাতি সম্পর্কিত এমন কিছু বই না পড়ে উপায় নেই। আধুনিক কালের তরুণ লেখদের হাতে ইহুদী জাতি সংক্রান্ত যে ক’টি বই লেখা হয়েছে, তার মধ্যে “দ্য কিংডম অব আউটসাইডারস” আমাকে বিশেষ ভাবে সহযোগীতা করেছে। মূলতঃ আমি সহজ ভাষার পাঠক। এক্ষেত্রে সহজ-সরল, বোধগম্য ভাষায় ইতিহাসের গভীর থেকে পাঠককে ট্রাভেল করিয়ে নিয়ে আসার গুণটি লেখক “সোহেল রানার” রয়েছে। ইতিহাস কিংবা যেকোনো ইনফরমেটিভ ডকুমেন্টারি জনরার বই পড়তে গেলে ইনফরমেশনের অবিরত প্রয়োগের ফলে বই পড়ার মজা নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এই বইটির ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি। লেখক খুব সাবলীলভাবে ১৯৪৮ সালের ইজরায়েল রাষ্ট্র প্রতিস্থাপনের প্রেক্ষাপট এবং তার আগে পিছের সমস্ত ঘটনা উপস্থাপন করেছেন। ইজরায়েলের সাথে সম্পর্কযুক্ত সকল আলোচিত ঘটনা এখানে স্থান পেয়েছে অনেক গভীর আলোচনার আলোকে। এতে করে রহস্য বা জলঘোলা অবস্থাগুলো আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। জ্ঞানপীপাসু পাঠকের জন্য আর কি চাই!