তেতুল বনে জোছনা
#রিভিউ কিছু কিছু বইয়ের ভালো লাগা প্রকাশ করতে নেই।পুষিয়ে রাখতে হয় নিজের ভিতরে।কেননা সব ভালো লাগা দু চার লাইন লিখে বোঝানো সম্ভব না,এটি কতটুকু জুড়ে ছড়িয়ে আছে।কিভাবে গেঁথে রয়েছে মনের ভেতর।হুমায়ূন আহমেদের "তেতুল বনে জোছনা",আমার পড়া ঠিক তেমনি এক উপন্যাস। ধারণা থেকে বলা যায়,হুমায়ূন প্রেমীরা সকলেই পড়ে ফেলেছে। যদি কারো পড়া না হয়ে থাকে,তবে বাজি ধরে বলতে পারি, তারা পাঠক হিসেবে অনেক বড় পাওনা থেকে বঞ্চিত। আজ রিভিউ এর আদলে,কিছু অনুভূতি শেয়ার করবো মাত্র।যদি কারো ইচ্ছে হয়,তাহলে মতবিনিময়ে অংশ নিতে পারেন। 'কাউকে খুব ভালোবাসি'।এই অনুভূতি প্রকাশ করতে হয় কিভাবে ? -সারাজীবন পাশাপাশি থেকে? -তেতুল বনে জোছনাকে সাক্ষী রেখে ভালোবাসার দিব্যি দিয়ে? ---নাকি,সাতসাগর তেরো নদী'র পাড়ে বসে বলা 'দু ফোটা চোখের জলের বিনিময়ে জনম জনম কাঁদিব',এমন স্বীকারোক্তিতেও লুকিয়ে থাকে অব্যক্ত ভালোবাসা??? এর উত্তর মনে হয় গল্পের জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ লিখে রেখে গেছেন এ উপন্যাসে।চিত্র এঁকেছেন দুই প্রান্তের দু হৃদয়ের ভালোবাসার।পাশাপাশি থেকেও কাছে না পাবার ব্যাথা,দুরে থেকেও দুরে সরে যেতে না পারার কষ্ট একই সাথে আগলে রেখেছে পথ।না বলা কথাগুলো প্রিয়জনকে বলা হয়ে উঠেনা কোনোদিন।একজীবন নিঃসঙ্গতার মাঝে সামান্য ভালোবাসা পাবার কাঙ্গাল হয়ে, তবুও তারা বেচে থাকে আজন্মকাল।অপর দিকে অন্যান্য চরিত্রায়নে বাস্তবতা ও আবেগ আচড় কেটেছে সুনিপুণ ভাবে।সেখানে দেখতে পাওয়া যায়, ছ্যাচকা চোরের মাঝেও যেমন উদারতার বিশাল উদাহরণ।তেমনি প্রভাবশালী ব্যক্তির ক্ষমতাবলের অপব্যবহার।নিজেকে ঠিকিয়ে রাখার যুদ্ধ যাদের জীবন।উপন্যাসের সকল চরিত্র ফুটে উঠেছে আপন স্বত্তায়।সর্বোপরি অনন্য বৈচিত্র্য দিয়ে সাজানো এর পট। বিরাট নগর গ্রাম।নামের সাথে মিল রেখে গায়ের ছোট ঘটনাগুলিও ছড়িয়ে পরে বড় করে।আর সেসব ঘটনা ঘটা রেখে রটার পিছনে থাকে চেয়ারম্যান জহির খাঁ'র ইশারা।ক্ষমতাবান লোকেরা তাদের ক্ষমতা দেখাতে পছন্দ করেন।তিনিও ব্যক্তিক্রম নন।কিন্তু সমস্যা বেধেছে অন্যখানে।লোকমুখে শোনা যাচ্ছে আজিজ মিয়া নাকি তার সাথে পাল্লা দিতে নেমেছে।আরে সেদিনই তো অন্যের দেয়া টাকায় চলতে হতো তাকে।আর আজ হাতে কয়েকটা টাকা আসায় পুরোনো সব ভুলে গেলো।জহির খাঁ'র মতো ধুরন্ধর লোকের সাথে লাগার আগে কি তার একবারেও বিষয়টি ভালোভাবে ভেবে দেখা উচিত ছিলনা? নবনী অনেক ভেবেও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা সে কি করবে।অনেক কঠিন সময় পাড়ি দিচ্ছে সে।প্রতিরাতে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়।কাউকে না জানিয়ে সে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখিয়েছে।তিনি বলেছেন স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে আলাদা থাকলেই তার সমস্যা কেটে যাবে।নবনীর স্বামী আনিস পেশায় ডাক্তার। শহর থেকে পাশ করে এখন গ্রামে ডাক্তারি করছে।গ্রামের লোকের কাছে তার কদর ভালো।সবাই বলাবলি করে তার সাইকেলের ঘন্টা শুনলেই নাকি রোগ পালিয়ে যায়।যা রটে কিছু তো বটে।তবুও আনিস সাহেব এসব গুজবে কান লাগায় না।নিজের মতো করে চলতে থাকে,আর অতিবাহিত করে একেরপর এক নিষঙ্গ দিন।এই অজপড়া গায়ে যে কেউ তার খোজ রাখেনা,তা কিন্তু নয়।মতি মিয়া নিয়মিত তাকে চুপিচুপি দেখে যায়।কোনো অজানা কারনে এই একা মানুষটাকে তার খুব ভালো লাগে।মতি মিয়া চোর হলেও শৌখিনতা প্রবল।কিছুদিন থেকে জ্বরের ওষুধ বানানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সফল হচ্ছেনা।ডাক্তারের পরামর্শের সুযোগ খুজছে সে। সারাদিন চুরি করে সন্ধায় অন্ধকারে বসা ডাক্তার কে দেখে দিন পার হয় তার।এইভাবে গড়িয়ে চলে বিরাট নগরের ছোট দিনগুলি...... পাঠ প্রতিক্রিয়াঃযা বলার প্রথমেই বলে ফেলেছি,বাকি যা আছে তা উপন্যাসে।বইয়ের প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে মুদ্ধ করেছে।খুব কাছে থেকে অনুভব করেছি দৃশ্যগুলো।ভালোবাসা, মায়া, ভিলেজ পলিটিক্স সব মিলিয়ে অসাধারণ। সাধারণ জীবনের গল্প হলেও অসম্ভব সুন্দর করে ফুটে উঠেছে সেই জীবন।চোরা মতি,নিঃসঙ্গ আনিস,বেখেয়ালি নবনী,ধুরন্ধর জহির খাঁ,সবাই মন ছুঁয়ে গেছে।অবশ্য আমি মতি মিয়ার কাজ কর্মে একটু বেশি মজা পেয়েছি। পড়ে দেখতে পারেন, আশাকরি হতাশ হবেননা। প্রচ্ছদঃআমার ছবিতে যে প্রচ্ছদ দেয়া আছে,তা পুরোনো সংস্করনের। নতুন সংস্করনে প্রচ্ছদ পাল্টে গেছে।আমার কাছে নতুনটি একদম ভালো লাগেনি।পুরোনোটার সাথে গল্পের বেশ মিল ছিল।বইটা শেষ করে কভারের দিক তাকালে বুকে হাহাকারের সুর বেজে উঠতো।চোখের সামনে দেখতাম ডাক্তার সাহেবের সেই শশান,সেই সাইকেল, সেই নিষঙ্গতা,যাতে মিশে গেছে তেতুল বনের জোছনা।নতুন প্রচ্ছদে এসব খুজে পাইনি,সেকারনেই হয়তো নতুনটার উপর নারায। বইঃতেতুল বনে জোছনা লেখকঃহুমায়ূন আহমেদ প্রকাশনীঃঅন্য প্রকাশ রেটিংঃ১০/১০