"সুলতান মাহমুদ গজনবীর ভারত অভিযান - ২" বইটির আমাদের আরয অংশ থেকে নেয়াঃ
'মাহমুদ গজনবীর ভারত অভিযান' সিরিজের এটি দ্বিতীয় খণ্ড। উপমহাদেশের ইতিহাসে সুলতান মাহমূদ গজনবী সতের বার ভারত অভিযান পরিচালনাকারী মহানায়ক হিসেবে খ্যাত। সুলতান মাহমূদকে আরাে খ্যাতি দিয়েছে পৌত্তলিক ভারতের অন্যতম দু ঐতিহাসিক মন্দির সােমনাথ ও থানেশ্বরীতে আক্রমণকারী হিসেবে। ঐসব মন্দিরের মূর্তিগুলােকে ভেঙে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলেন মাহমুদ। কিন্তু উপমহাদেশের পাঠ্যপুস্তকে এবং ইতিহাসে মাহমূদের কীর্তির চেয়ে দুষ্কৃতির চিত্রই বেশী লিখিত হয়েছে। হিন্দু ও ইংরেজদের রচিত এসব ইতিহাসে এই মহানায়কের চরিত্র যেভাবে চিত্রিত হয়েছে তাতে তাঁর সুখ্যাতি চাপা পড়ে গেছে। মুসলিম বিদ্বেষের ভাবাদর্শে রচিত ইতিহাস এবং পরবর্তীতে সেইসব অপইতিহাসের ভিত্তিতে প্রণীত মুসলিম লেখকরাও মাহমূদের জীবনকর্ম যেভাবে উল্লেখ করেছেন তা থেকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বােঝার উপায় নেই, তিনি যে প্রকৃতই একজন নিবেদিতপ্রাণ ইসলামের সৈনিক ছিলেন, ইসলামের বিধিবিধান তিনি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেন। জাতিশত্রুদের প্রতিহত করে খাঁটি ইসলামী শাসনব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও দৃঢ়করণের জন্যেই নিবেদিত ছিল তার সকল প্রয়াস। অপলেখকদের রচিত ইতিহাস পড়লে মনে হয়, সুলতান মাহমূদ ছিলেন লুটেরা, আগ্রাসী ও হিংস্র। বারবার তিনি ভারতের মন্দিরগুলােতে আক্রমণ করে সােনা-দানা, মণি-মুক্তা লুট করে গজনী নিয়ে যেতেন। ভারতের মানুষের উন্নতি কিংবা ভারতকেন্দ্রিক মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা তার কখনাে ছিল না। যদি তৎকালীন ভারতের নির্যাতিত মুসলমানদের সাহায্য করা এবং পৌত্তলিকতা দূর করে ইসলামের আলাে ছড়িয়ে দেয়ার একান্তই ইচ্ছা তাঁর থাকতাে, তবে তিনি কেন মােগলদের মতাে ভারতে বসতি গেড়ে ইসলামী শাসনব্যবস্থা গড়ে তুললেন ? ইত্যাকার বহু কলঙ্ক এঁটে তার চরিত্রকে কলুষিত করা হয়েছে।
মাহমূদ কেন বার বার ভারতে অভিযান চালাতেন? মন্দিরগুলাে কেন তার টার্গেট ছিল? সফল বিজয়ের পরও কেন তাকে বার বার ফিরে যেতে হতাে গজনী? ইত্যাদি বহু প্রশ্নের জবাব; ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ সৈনিক সুলতান মাহমূদকে তুলে ধরার জন্যে আমার এই প্রয়াস। নির্ভরযােগ্য দলিলাদি ও বিশুদ্ধ ইতিহাস ঘেঁটে আমি এই বইয়ে মাহমূদের প্রকৃত জীবনচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। প্রকৃতপক্ষে সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর মতােই মাহমূদকেও স্বজাতির গাদ্দারি এবং বিধর্মী পৌত্তলিকদের বিরুদ্ধে একই সাথে লড়াই করতে হয়েছে। যতাে বার তিনি ভারত অভিযান চালিয়েছেন, অভিযান শেষ হতে না হতেই খবর আসতাে, সুযােগসন্ধানী সাম্রাজ্যলােভী প্রতিবেশী মুসলিম শাসকরা গজনী আক্রমণ করেছে। কেন্দ্রের অস্তিত্ব রক্ষার্থে বাধ্য হয়েই মাহমূদকে গজনী ফিরে যেতে হতাে। একপেশে ইতিহাসে লেখা হয়েছে, সুলতান মাহমূদ সতের বার ভারত অভিযান চালিয়েছিলেন, কিন্তু এ কথা বলা হয়নি, হিন্দু রাজা-মহারাজারা মাহমূদকে উৎখাত করার জন্যে কত শত বার গজনীর দিকে আগ্রাসন চালিয়েছিল। সুলতান মাহমূদের বারবার ভারত অভিযান ছিল মূলত শত্রুদের দমিয়ে রাখার এক কৌশল। তিনি যদি এদের দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হতেন, তবে হিন্দুস্তানের পৌত্তলিকতাবাদ সাগর পাড়ি দিয়ে আরব পর্যন্ত বিস্তৃত হতাে। মাহমূদের পিতা সুবক্তগীন তাকে অসীয়ত করে গিয়েছিলেন, ‘বেটা! ভারতের রাজাদের কখনও স্বস্তিতে থাকতে দিবে না। এরা গজনী সালতানাতকে উৎখাত করে পৌত্তলিকতার সয়লাবে কাবাকেও ভাসাতে চায়। মুহাম্মদ বিন কাসিমের সময়ের মতাে ভারতীয় মুসলমানদেরকে হিন্দুরা জোর জবরদস্তি হিন্দু বানাচ্ছে। এদের ঈমান রক্ষার্থে তােমাকে পৌত্তলিকতার দুর্গ গুড়িয়ে দিতে হবে। ভারতের অগণিত নির্যাতিত বনি আদমকে আযাদ করতে হবে, তাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে হবে।
আলবিরুনী, ফারিতা, গারদিজী, উতবী, বাইহাকীর মতাে বিখ্যাত ও নির্ভরযােগ্য ইতিহাসবিদগণ লিখেছেন, সুলতান মাহমূদ তৎকালীন সবচেয়ে বড় বুযুর্গ ও ওলী শাইখ আবুল হাসান কিরখানীর মুরীদ ছিলেন। তিনি বিজিত এলাকায় তার হেদায়েত মতাে পুরােপুরি ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
তিনি নিজে কিরখানীর দরবারে যেতেন। কখনও তিনি তাঁর পীরকে তাঁর দরবারে ডেকে পাঠাননি। উপরন্তু তিনি ছদ্মবেশে পীর সাহেবের দরবারে গিয়ে ইসলাহ ও পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তিনি আত্মপরিচয় গােপন করে কখনও নিজেকে সুলতানের দূত হিসেবে পরিচয় দিতেন। একবার তাে আবুল হাসান কিরখানী মজলিসে বলেই ফেললেন, “আমার এ কথা ভাবতে ভালাে লাগে যে, গজনীর সুলতানের দূত সুলতান নিজেই হয়ে থাকেন। এটা প্রকৃত মুসলমানেরই আলামত। মাহমূদ কুরআন, হাদীস ও দীনি ইলম প্রচারে খুবই যত্নবান ছিলেন। তাঁর দরবারে আলেমদের যথাযথ মর্যাদা ছিল। সবসময় তার বাহিনীতে শত্রুপক্ষের চেয়ে সৈন্যবল কম হতাে, কিন্তু তিনি সব সময়ই বিজয়ী হতেন। বহুবার এমন হয়েছে যে, তাঁর পরাজয় প্রায় নিশ্চিত। তখন তিনি ঘােড়া থেকে নেমে ময়দানে দু'রাকাত নামায আদায় করে মােনাজাত করতেন এবং চিৎকার করে বলতেন, ‘আমি বিজয়ের আশ্বাস পেয়েছি, বিজয় আমাদেরই হবে। বাস্তবেও তাই হয়েছে। অনেকেই সালাহ উদ্দীন আইয়ুবী আর সুলতান মাহমূদকে একই চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের বীরসেনানী মনে করেন। অবশ্য তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য একই ছিল। তাদের মাঝে শুধু ক্ষেত্র ও প্রতিপক্ষের পার্থক্য ছিল। আইয়ুবীর প্রতিপক্ষ ছিল ইহুদী ও খ্রিস্টশক্তি আর মাহমূদের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল হিন্দু পৌত্তলিক রাজন্যবর্গ। ইহুদী ও খ্রিস্টানরা সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর সেনাদের ঘায়েল করতে প্রশিক্ষিত সুন্দরী রমণী ব্যবহার করে নারী গােয়েন্দা দিয়ে, আর এর বিপরীতে সুলতান মাহমূদের বিরুদ্ধে এরা ব্যবহার করতাে শয়তানী যাদু। তবে ইহুদী-খ্রিস্টানদের চেয়ে হিন্দুদের গােয়েন্দা তৎপরতা ছিল দুর্বল, কিন্তু সুলতানের গােয়েন্দারা ছিল তৎপর ও চৌকস। তবে এ কথা বলতেই হবে, সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর গােয়েন্দারা যেমন দৃঢ়চিত্ত ও লক্ষ্য অর্জনে অবিচল ছিল, মাহমূদের গােয়েন্দারা ছিল নৈতিক দিক দিয়ে ততটাই দুর্বল। এদের অনেকেই হিন্দু নারী ও যাদুর ফাঁদে আটকে যেতাে। অথবা হিন্দুস্তানের মুসলিম নামের কুলাঙ্গাররা এদের ধরিয়ে দিতাে। তারপরও সালাহ উদ্দীন আইয়ুবীর চেয়ে সুলতান মাহমূদের গােয়েন্দা কার্যক্রম ছিল বেশি ফলদায়ক।
ইতিহাসকে পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য, বিশেষ করে তরুণদের কাছে হৃদয়গ্রাহী করে পরিবেশনের জন্যে গল্পের মতাে করে রচনা করা হয়েছে এই গ্রন্থ। বাস্তবে এর সবটুকুই সত্যিকার ইতিহাসের নির্যাস।