একদিক দিয়া দেখিতে গেলে শ্রীকান্ত শরৎচন্দ্রের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ইহাকে ঠিক উপন্যাস বলা চলে কিনা, তাহা একটু বিবেচনার বিষয়। উপন্যাসের নিবিড়, অবিচ্ছিন্ন ঐক্য ইহার নাই; ইহা কতকগুলি ভিন্ন ভিন্ন সময়ের বিচ্ছিন্ন পরিচ্ছেদের সমষ্টি। কিন্তু ইহার গ্রন্থন-সূত্রটা যতই শিথিল হউক না কেন, গ্রথিত পরিচ্ছেদগুলি এক-একটি মহামূল্য রত্ন। যাহাদের জীবন চিরদিন একটা অভ্যস্ত গণ্ডির মধ্যে কাটিয়াছে, যাহারা জীবিকার্জনের ও সংসার-প্রতিপালনের প্রচন্ড নেশায় অনেকটা অর্ধচেতনভাবে জীবনটা অতিবাহিত করিয়াছে, তাহারা শ্রীকান্ত'-এর দৃশ্যগুলির অসাধারণ বৈচিত্র্যে ও অভিনবত্বে একেবারে অভিভূত হইয়া পড়িবে। আমাদের স্কুল-কলেজ-অফিসের লৌহনিগড়-বদ্ধ, রােগ-শােক-জর্জরিত, দলাদলি-বিরােধ-কন্যাদায়-বিড়ম্বিত বাঙালি-জীবনের প্রান্তসীমায় যে বিচিত্র রসভভাগের এত প্রচুর অবসর আছে, দুঃসাহসিকতার এত ব্যাকুল, প্রবল আকর্ষণ আছে, সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও সমালােচনার এরূপ বিশাল, অব্যবহৃত ক্ষেত্র পড়িয়া আছে, চক্ষুর ও হৃদয়ের এত অপর্যাপ্ত রসদ মজুত আছে তাহা আমাদের কল্পনাতেও আসে না। এই কল্পনাতীত বিচিত্র সৌন্দর্য ‘শ্রীকান্ত আমাদের মুগ্ধ নয়নের সম্মুখে আনিয়া ধরিয়াছে ও মুক্তহস্তে আমাদের পাতে পরিবেশন করিয়াছে। শ্রীকান্তের ভাগ্যে যে সমস্ত বিচিত্র, বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা লাভ হইয়াছে তাহা শরৎচন্দ্রের অন্যান্য উপন্যাসে মানসিক উদারতা ও সূক্ষ্ম নীতিজ্ঞানের মূল; যে আলােক তাঁহার অন্যান্য উপন্যাসে ছড়াইয়া পড়িয়াছে ‘শ্রীকান্ত’-এই তাহার আদি উৎস।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক। তিনি ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতের প্রেসিডেন্সি বিভাগের হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মতিলাল চট্টোপাধ্যায় ও মাতার নাম ভুবনমোহিনী দেবী। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে শরৎচন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। তাঁর দিদি অনিলা দেবী ছাড়াও প্রভাসচন্দ্র ও প্রকাশচন্দ্র নামে তাঁর দুই ভাই ও সুশীলা দেবী নামে তাঁর এক বোন ছিল। শরৎচন্দ্রের ডাকনাম ছিল ন্যাঁড়া। দারিদ্র্যের কারণে মতিলাল স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ভাগলপুরেশ্বশুরবাড়িতে থাকতেন বলে শরৎচন্দ্রের শৈশবের অধিকাংশ সময় এই শহরেই কেটেছিল। আর তার সাহিত্যকর্মের জন্যে পাঠকের কাছে তিনি 'অপরাজেয় কথাশিল্পী' নামে কথিত হন।