ভূমিকা অনুপম প্রকাশনী থেকে ‘সোনালি দিনের গান’ নামে আধুনিক বাংলা গানের স্বরলিপি সংকলন প্রকাশিত হচ্ছে। স্বরলিপিকার নিখিল রঞ্জন নাথ। এ ধরনের গ্রন্থ প্রকাশ যে আমাদের সংগীত চর্চার সহায়ক সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।আর স্বরলিপি যিনি প্রণয়ন করেছেন এ ব্যাপারে তাঁর যোগ্যতা সম্পর্কেও আমার ধারণা অতি উচ্চ। এখন থেকে বছর বিশেক আগে হবে হয়তো, কিশোরগঞ্জ শিল্পকরা একাডেমীর আমন্ত্রণে নিখিলরঞ্জন নাথের আধুনিক সংগীত স্বরলিপি সংকলন গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে প্র্রধান অতিথি হিসেবে আমি যোগ দিয়েছিলাম। ব্যাপারটা যে কেমন হবে সে সম্পর্কে আমার গানের স্বরলিপি প্রণয়ন ছিলা না। কিন্তু উৎসবে গিয়ে বিস্ময় মানি। নিখিল রঞ্জন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্যভাবে শত আধুনিক গানের স্বরলিপি প্রণয়ন করেছেন, তারই সংকলন গ্রন্থ নিয়ে প্রকাশনা উৎসব। তখনো এমন কোনো গ্রন্থ ঢাকা থেকেই বের হয়নি। কিশোরগঞ্জে বসে নিখিল রঞ্জনের মতো একজন প্রকৌশলী এমন কঠিন একটি কাজ এতোটা নিখুঁতভাবে করবার চেষ্টা করছেন এবং এর একটি প্রকাশনা উৎসবে আমন্ত্রিত হয়ে গেছি ভাবে বিস্ময় ও আনন্দ দুইই অনুভব করলাম। নিখিল রঞ্জন নাথের কাজের সঙ্গে সেই আমার পরিচয়।এর পর থেকে তাঁর কাজের প্রতি আমি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছি এবং দেখছি যে, স্বরলিপি করার মতো একটি কঠিন কাজকে তিনি এত সহজভাবে গ্রহণ করেছেন। পরবর্তী বছরগুলোয় তিনি বহু গানের স্বরলিপি করেছেন এবং তাঁর অনেক স্বরলিপি মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে এবং স্বরলিপি সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে একাধিক।বাংলা আধুনিক গানের, বিশেষ করে গেল শতকের ত্রিশ, চল্লিশ এবং পঞ্চাশের দশকের জনপ্রিয় আধুনিক গানের স্বরলিপি করার প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি।নিখিল রঞ্জন নাথের করা আধুনিক বাংলা গানের স্বরলিপি থেকে নির্বাচিত ১৬৪ টি গানের স্বরলিপি প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন অনুপম প্রকাশনীর সত্ত্বাধিকারী মিলন নাথ। তিনি সংগীতের ক্ষেত্রটিকে নিয়ে কয়েক বছরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনার কাজ সম্পন্ন করেছেন। বর্তমান স্বরলিপি সংকলন গ্রন্থটিও এর ব্যতিক্রম হবে না। বাংলা আধুনিক গানের সূচনা রবীন্দ্রনাথের হাতে। ১৮৮৮ সালে মায়ার খেলা গীতিনাট্যে কালজয়ী সব আধুনিক গানের সমালোহ ঘটিয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ আধুনিক সংগীত রীতি বলতে বুঝতেন এমন এক রচনারীতিকে যা হিন্দুস্তানি দরবারি গানের একান্ত প্রভাব মুক্ত। বাংলা নাগরিক গানের পটভূমিতে রয়েছে ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা, ঠংরি প্রভৃতি হিন্দুস্তনি রীতি। রবীন্দ্রনাথের চেষ্টা ছিল এই পটভূমিকে স্বীকার করে নিয়েই এর নিয়ম কানুনের জটিল বন্ধন থেকে সংগীত রচনারীতিকে মুক্ত করে অগ্রসর হওয়া। তিনি এ কাজে অসামান্য সাফল্য লাভ করেছিলেন। বিশ শতকের সূচনায় প্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশ হতে শুরু করলে গান প্রচারের ব্যাপারটি এক যুগান্তকারী সমর্থন পায়। কিন্তু পরে রেডিও এবং সবাক চলচ্চিত্রের প্রচলন ঘটলে গীতপ্রচার অধিকতর জনসংলগ্নতা অর্জন কর তখন গানের একটি বিক্রয়মূল্য দাঁড়িয়ে যায়। মানুষ রেকর্ড কিনে গান গুনছেন, কোনো কোনো গানের জোরে সিনেমা জনপ্রিয়তা পায়। সে সময় এসে গীতিকার-সুরকার-গায়ক শ্রমবিভাজন রীতি চালু হয়। আগে এমনটি কখনো হয়নি। এই নতুন যুগের সূচনাকালীন নেতৃত্বে দেন কাজী নজরুল ইসলাম। ত্রিশের দশক ও তার পরবর্তীকালে নক্ষত্রপ্রতিম সব গীতিকার, সুরকার ও গায়কের আবির্ভাব ঘটে। যন্ত্রসংগীত সহযোগেও উৎকষ.. ঘটাতে থাকে ক্রমে ক্রমে। রেকর্ড করার যান্ত্রিক সমর্থনেরও বিস্ময়কর বিকাশ ঘটে। এই সমস্ত মাত্রাকে স্বীকার করে নিয়ে আধুনিক বাংলা গান বিকশিত হতে থাকে। বাংলা গান চিরকালিই কাব্যভাবাপন্ন। রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল, রচনীকান্ত, অতুল প্রসাদ ও নজরুল আধুনিক বাংলা গানের বিকাশের এই কাব্যভাবাপন্ন। পটভুমিটি নির্মাণ করেন। সংগীতের সহযোগেই কাব্যের ব্যঞ্জনা এখানে তীব্র হয়ে ওঠে।এই ধরাকেই বহন করে চলেন নক্ষত্রপ্রতিম রচয়িতাগণ। বাংলা গানের ইতিহাসের এ যাবৎ সর্বশেষ অত্যুজ্জ্বল ধারাটি রচনা করে আধুনিক বাংলা গান। 0সেখান থেকে ১৬৪টি গান নির্বাচন করে স্বরলিপিসহ প্রকাশ করা একটি চমৎকার কাজ হিসেবে বিবেচিত হবে।আমাদের কণ্ঠশিল্পীরা ও সঙ্গীতামোদী সমাজ এই কাজ দ্বারা নিশ্চয়ই উপকৃত হবেন।আমি অনুপম প্রকাশনীর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই ও এর সাফল্য কামনা করি।এই প্রকাশনা কর্মটিকে সর্বাঙ্গ সুন্দর করার জন্যে সংগীত শিল্পী শ্রী দিলীপ বিশ্বাস অশেষ পরিশ্রম স্বীকার করেছেন। তাঁকে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানাই। করুণাময় গোস্বামী ঢাকা, ১১ জানুয়ারি, ২০১০