ব্রিজ একটি কাঠামাে; সব কিছুই আমার কাছে কাঠামাে’, বলেছে সব কিছু ভেঙে পড়ের নায়ক, সেতু-প্রকৌশলী, মাহবুব; সে আরাে বলেছে, ‘বিশতলা টাওয়ার, জানালার গ্রিলে বৃষ্টির ফোটা, শিশিরবিন্দু, সভ্যতা, বুড়িগঙ্গার ব্রিজ, সমাজ, সংসার, বিবাহ, পনেরাে বছরের বালিকা, তার বুক, দুপুরের গােলাপ, দীর্ঘশ্বাস, ধর্ম, আর একটির পর একটি মানুষ—পুরুষ, নারী, তরুণী, যুবকের সাথে আমার সম্পর্ক, অন্যদের সম্পর্ক, সব কিছুই, আমার কাছে কাঠামাে।
কাঠামাের কাজ ভার বওয়া; যতােদিন ভার বইতে পারে ততােদিন তা টিকে থাকে; ভার বইতে না পারলে ভেঙে পড়ে। কোনাে কাঠামােই চিরকাল ভার বইতে পারে না।
মাহবুব জানে, ‘সত্য হচ্ছে ভেঙে পড়া, কাঠামাের কাজ ওই ভেঙে পড়াকে, চরম সত্যকে, কিছু কালের জন্যে বিলম্বিত করা; কিন্তু একদিন সব কাঠামােই ভেঙে পড়বে।
হুমায়ুন আজাদের সব কিছু ভেঙে পড়ের বিষয় নারীপুরুষের শারীরিক ও হৃদয়সম্পর্কের কাঠামােটি। নারীপুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ বােধ করবে, এটা তাদের নিয়তি; এবং আরাে মর্মান্তিক নিয়তি হচ্ছে তাদের আকর্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হবে না।
সব কিছু ভেঙে পড়ের নায়ক মাহবুব ব্রিজের পর ব্রিজ বানিয়েছে, নদীর ওপর তার ব্রিজগুলাে টিকে আছে, যদিও একদিন ভেঙে পড়বে; কিন্তু ওই ব্রিজের থেকেও শক্ত উপাদানে সে মানুষের সাথে, নারীর সাথে, অনেকগুলাে মানবিক সেতু সৃষ্টি করেছিলাে, তার একটিও টেকে নি, একের পর এক ভেঙে পড়েছে।
বিবাহ ভেঙে পড়েছে, প্রেম ভেঙে পড়েছে, কাম ভেঙে পড়েছে; কোন কাঠামােই টেকে নি। মাহবুব বলেছে, পৃথিবী জুড়ে মহাজগত জুড়ে ভেঙে পড়ার শব্দ হচ্ছে; আমি ভাঙা দালানের ।
ভেতর দিয়ে পথ থেকে পথে ছুটছি, দালানের পর দালান ভেঙে পড়ছে, শহর ভেঙে পড়ছে, আমি অন্ধকারে ভেঙে পড়া দালানের পর দালানের ভেতর দিয়ে ছুটছি, কী যেনাে খুঁজছি, আমার চারদিকে। দালান ভেঙে পড়ছে, শহর ভেঙে পড়ছে, সব কিছু ভেঙে পড়ছে।
অসামান্য গদ্যে হুমায়ুন আজাদ এ-উপন্যাসে উদঘাটন করেছেন নারীপুরুষের সম্পর্কের নিয়তি—সব কিছু ভেঙে পড়ে।
হুমায়ুন আজাদ
হুমায়ুন আজাদ (২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ - ১১ আগস্ট ২০০৪; ১৪ বৈশাখ ১৩৫৪ - ২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ছিলেন একজন বাংলাদেশী কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সমালোচক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার। তিনি বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক লেখক যিনি ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান- ও সংস্কারবিরোধিতা, নিরাবরণ যৌনতা, নারীবাদ ও রাজনীতি বিষয়ে নির্মম সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য ১৯৮০-র দশক থেকে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
২০০২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের উপর কাজ করার জন্য জার্মান সরকারের নিকট একটি বৃত্তির আবেদন করেছিলেন। ২০০৪-এর ৭ আগস্ট জার্মান কবি হাইনরিখ হাইনের ওপর গবেষণা বৃত্তি নিয়ে জার্মানি যান।
২০০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ আগস্ট রাতে একটি পার্টি থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আবাসস্থলে আকস্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন হুমায়ুন আজাদ। ১২ আগস্ট ফ্ল্যাটের নিজ কক্ষে তাকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।