মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় রোগসমূহের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোগটি হল তাওহীদের ধারণা সম্পর্কে বিভ্রান্তি এবং এ বিষয়ে বিশুদ্ধ জ্ঞানের দুঃখজনক অপর্যাপ্ততা। মুসলিম জীবনে আল্লাহ্ একত্রে ব্যাপ্তি এবং ত্ব কতখানি তা মুসলিমরাই সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারছে না। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। এ কথা বলার আপেক্ষা রাখে না যে, তাওহীদ বা আল্লাহর একত্ই হচ্ছে ইসলামের মূল ও কেন্দ্রীয় শক্তি। মুসলিম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এর ব্যাপ্তি সম্পর্কে অবহিত হওয়া, আমৃত্যু সঠিকভাবে মুসলিম হিসেবে বেঁচে থাকা নির্ভর করে তাওহীদ সম্পর্ক ঠিক রা ওপর। মুসলিমদের আধ্যাত্মিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যক্রম তাওহীদের ধারণাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত।
তাওহীদের বিপরীত হচ্ছে শির্ক। শির্ক হচ্ছে কঠিন ও জঘন্যতম পাপের কাজ, যার সাথে নগণ্যতম সম্পর্কও কোন প্রকৃত তাওহীদপন্থী মুসলিম মেনে নিতে পারে না। অধিকাংশ মুসলিম তাওহীদের মূল তাৎপর্য উপলব্ধি করতে ভ্রান্তিতে নিপতিত হয়েছে। তাওহীদের প্রকৃত সংজ্ঞা নিরূপণে তারা মূল সত্য থেকে দূরে সরে পড়েছে। তাওহীদপন্থী মুসলিমরাই যেহেতু এ জগত থেকে শির্ক নির্মূল করার এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অধিকারী। সে ক্ষেত্রে এ ধরনের বাতিলের মধ্যে নিজেদের নিপাতিত হওয়া কিরূপে সম্ভব?
মূলত, শির্কের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ এবং তাওহীদের প্রতি ভালবাসা ও সহানুভূতি একটি জ্ঞানগত গৌরবের বিষয়। তাওহীদ বিষয়ে ব্যাপক অধ্যয়ন মানুষের মন থেকে শির্ক সম্বন্ধীয় সমূদয় অন্ধ ধারণাকে বিলীন করে দিতে সক্ষম। এর ফলে শির্কের জণ্ডালে জড়িয়ে পড়ার কোন সম্ভাবনা অবশিষ্ট থাকবে না। আসলে, শির্ক বিষয়টি কী? এর রূপরেখা ও প্রকরণ কী? আমাদের জ্ঞান, বিজ্ঞান, সাহিত্য, চরিত্র, নৈতিকতা ও সামাজিক-পারিবারিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক তথা আমাদের জীবনের রন্ধে রন্ধে এটা কিভাবে প্রভাব বিস্তার করে ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট ও বিশুদ্ধ জ্ঞানার্জন প্রতিটি মুসলিমের জন্য অত্যাবশ্যক।
তাওহীদের সঠিক জ্ঞানের অভাবে বাংলাদেশী মুসলিমদের সংস্কৃতি আজও প্রকৃত ইসলামীরূপ নেয়নি, বরং তা ইসলামী ভাবধারা হতে বিচ্যুত হয়ে একটা অস্পৃশ্য বিজাতীয় সংস্কৃতির ঘোলাটে ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। আজ অহর্নিশি মুসলিমদের কণ্ঠে শোনা যায়, হরে কৃষ্ণ সংকীর্তন এবং বড়দিনের নর্তন-কুর্দন। এ দেশীয় মুসলিমরা নিজেদের অজ্ঞতার কারণে বিদআতী-শিকী-কুফরী আচরণ করছে, ভিন্ন ধর্মের জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতির চর্চার দিকে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে; আর এর ফলে সর্বক্ষণ তারা কুসংস্কারের আবর্তে ঘুরপাক যাচ্ছে। হিন্দুদের তীর্থ-মন্দিরের বিকল্প হিসেবে মুসলিমরা মাযার গড়ে তুলছে, চর্চা করছে মাযার পূজা বা প্রতিমা সংস্কৃতির। বর্তমান মুসলিম জীবনের এ বিচিত্র দিকগুলো তুলে ধরার জন্য এ বইটি এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
আমাদের পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জীবনে রয়েছে হাজারো রকমে কুসংস্কার। স্বল্পশিক্ষিত ও ইসলামী জ্ঞানহীন লোকেরা ধর্মীয় ও প্রাত্যহিক জীবনের নানাবি আচার, প্রথা ও ইবাদতপন্থা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের উদ্ভট বিষয় আবিষ্কা মনোযোগী হয়ে পড়ে। সে সবের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও নতুন মাত্রা সংযোজনের জন্য আর নানাবিধ অদ্ভুত ধারণা ও পন্থার প্রচলনের উদ্ভব ঘটায়। কুসংস্কারগুলোকে করে তো আরও গতিশীল ও জনপ্রিয়। তাদের এ উদ্ভাবনী শক্তি সত্যিই বিস্মিত হওয়ার মতো একটি বিষয়। তাদের এ সকল শিরকী কর্মকাণ্ড তথা কুসংস্কারের মূল এত গভীরে প্রোথিত যে এত সহজে এর মূলোৎপাটন সম্ভব নয়। সহজ-সরল, ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মীয় জ্ঞানই জনগোষ্ঠীই মূলত এ ধারার অনুসারী। এদেরকে সঠিক ধর্মীয় জ্ঞান দেয়ার জন্য ও সম থেকে শির্ক, বিদআত ও কুসংস্কার দূরীকরণের নিমিত্তে চাই একটা সমন্বিত প্রয়াস। অর সে প্রয়াসে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে এ বইটি।
এক প্রগাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত জাহেলিয়াতে কুহেলিকায় পরিপূর্ণ বিশ্বমানবতাকে মুক্ত করে তাওহীদী আলোর দিকে পরিচালিত করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মদ (স)। তৎকালীন সমাজে প্রচলিত শির্ক-কুফরীযুক্ত যাবতীয় কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধ্যান- ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে প্রতিষ্ঠা করেন এক শির্কমুক্ত পরিচ্ছন্ন তাওহীদী ইসলাম সমাজ। বর্তমানে আমরা মুসলিম সমাজের দিকে গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাই। মুসলিম সমাজ শির্ক-বিদআত ও নানা কুসংস্কারের দুশ্ছেদ্য মায়াজালে বন্দী, বিশেষ করে পাক-ভারত উপমহাদেশের মুসলিম জনসাধারণ যেন এর শিকার হয়েছে অনেক বেশি।
গ্রামবাংলা ও শহরকেন্দ্ৰীক শত সহস্ৰ কুসংস্কারের সংযোজন করে লেখিকা এ শির্কের বেড়াজাল উম্মত বেসামাল গ্রন্থের কলেবর বৃদ্ধির প্রতি মনোযোগী হননি। কেবলমাত্র হাতে গোনা কয়েকটি কুসংস্কার ও শির্কী কর্মকাণ্ডের কথা বলে একটা গ্রহণযোগ্য চিত্র পাঠকের কাছে বোধগম্য করে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন এখানে। সমাজ সংস্কার একটা মহতী বিষয় হলেও তা খুবই দূরূহ ব্যাপার। সে জন্য চাই প্রতিভা আর পাণ্ডিত্য এবং যে বিষয়টি বেশি প্রয়োজন তা হল, জনগণকে প্রভাবিত করতে পারে এমন রচনাশৈলী তথা প্রভাব বিস্তারকারী সাহিত্য সৃষ্টির উন্নত কলা-কৌশল । মুসলিমদের লক্ষ্যহীন অসহায় জীবনধারাই লেখিকাকে এ জাতীয় গ্রন্থ প্রণয়নে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁর রচনায় যেমন রয়েছে উদ্দীপনা তেমনি রয়েছে চলার পথের সঠিক পাথেয় ও প্রেরণা।
নূরজাহান বিনতে আব্দুল মাজীদ (রুকু)
Title :
শির্কের বেড়াজাল উম্মত বেসামাল (পেপারব্যাক)