বাংলা গল্পসাহিত্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর । (১৯০৪-১৯৭৪) অবস্থান বৈচিত্র্যমণ্ডিত। ভ্রমণসাহিত্যিক হিসেবেই তাঁর খ্যাতি সমধিক। তাঁর রচিত গল্পগুলাে বিষয় ও প্রকরণে স্বতন্ত্র। তিনি শাস্ত্রীয় ছক মান্য করে ছােটগল্প রচনা করেননি। তিনি বৈঠকি রীতিতে গল্প বলতে চেয়েছেন। ড্রয়িং রুমে বা ক্যাফে-রেস্তোরায় প্রায় সমবয়সীদের মধ্যে আড্ডা জমে উঠলে যেমন টুকরাে টুকরাে কথা একেকটি পূর্ণাঙ্গ গল্পের জন্ম দেয়, মুজতবা । আলীর গল্পের স্বাদ অনেকটা সেরকম। এ কারণেই তাকে বলা হয় ‘মজলিশি ঢঙের গল্পশিল্পী। অবশ্য কেল বৈঠকি রীতিতেই নয়, প্রথাগত রীতিতেও তিনি গল্প। লিখেছেন। বহুদেশভ্রমণঋদ্ধ ও বহুভাষাবিজ্ঞ মুজতবা আলী তাঁর রচনায় হাস্যরস ও করুণরসকে বেণিবন্ধনের মতাে মিশিয়ে দিয়েছেন। হাস্যপ্রধান কিংবা কারুণ্যপ্রধান সব গল্পেই জুড়ে দিয়েছেন মানবিক অনুষঙ্গ। প্রাণতা ও সরসতাই তাঁর গল্পের প্রাণ।
সৈয়দ মুজতবা আলী
সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্ম ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ সালে, সিলেটের করিমগঞ্জে। পিতা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলী। শান্তিনিকেতন থেকে স্নাতক ১৯২৬-এ। এরপর আফগানিস্তানে কাবুলের শিক্ষাদপ্তরে ফরাসি ও ইংরেজি ভাষায় অধ্যাপক হিশেবে যােগ দেন। দুবছর পরে স্কলারশিপ নিয়ে যান জার্মানির বার্লিন ও বন বিশ্ববিদ্যালয়ে, তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৩২ সালে। ইউরােপ, এশিয়া ও আফ্রিকার নানা দেশে কর্মসূত্রে সঞ্চয় করেন বিচিত্র অভিজ্ঞতা। ১৯৩৪-৩৫ সালে পড়েন কায়রাের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর বরােদায়। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপনায় যােগ দেন। দেশ বিভাগের পরে চলে আসেন জন্মভূমি তকালীন। পূর্ব-পাকিস্তানে ১৯৪৭ সালেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে বক্তৃতা করেন সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদে। ১৯৪৯-এ অধ্যক্ষ হিসেবে যােগ দেন বগুড়া আজিজুল হক কলেজে। এখানে থাকাকালীন বাংলাভাষার সমর্থনে লেখেন পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' শীর্ষক প্রবন্ধ। সরকার কৈফিয়ত তলব করলে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ফিরে যান ভারতে। স্বল্পসময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি চাকরি শেষে যােগ দেন আকাশবাণীর উচ্চপদে, পরবর্তীতে বিশ্বভারতীর ইসলামি সংস্কৃতির প্রধান অধ্যাপক হিসেবে। সৈয়দ মুজতবা আলী ছিলেন বহুভাষাবিদ। ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান ইত্যাদি ইউরােপীয় ভাষা ও আরবি, ফারসি, উর্দু, হিন্দি, সংস্কৃত, গুজরাটি, মারাঠি ইত্যাদি প্রাচ্য ও ভারতীয় সহ মােট পনেরােটি ভাষা জানতেন তিনি। বহু ভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলী বাংলা রসরচনায় মৌলিক অবদানের জন্য অবিস্মরণীয়। উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ ‘দেশে বিদেশে’, ‘শবৃনম’, ‘ময়ূরকণ্ঠী’, ‘হিটলার’, ‘চাচা কাহিনী', ‘ধূপছায়া’, ‘জলে ডাঙায়’, ‘মুসাফির’, ‘পঞ্চতন্ত্র, ‘অবিশ্বাস্য’, ‘ভবঘুরে ও অন্যান্য’, ‘টুনিমেম', ইত্যাদি। ১৯৪৯-এ দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক নরসিংহদাস সাহিত্য পুরস্কারে সম্মানিত হন। বাংলাদেশে ফেরেন ১৯৭২-এ ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪-এ জীবনাবসান বাংলাদেশেই। সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিশেবে পান একুশে পদক ২০০৫ (মরণােত্তর)।