ভ্রমণ কাহিনীর ঢঙে লেখা হলেও প্রচলিত অর্থে এটি নিছক কোন ভ্রমণ কাহিনী নয়। এই ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭১ সালের ঘটনা ও তাৎপর্য সম্পর্কে পাকিস্তানী মনোভঙ্গীর অন্বেষণ, যা অত্যন্ত সুচারুরূপে উপস্থাপিত হয়েছে এই বইটিতে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল বাঙালীর বিজয়ের গৌরবে কিন্তু এজন্য তাকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ - হালাকু খানের কৃত্ব তালিকায় এমন কোন নির্যাতন নেই, যার মুখোমুখি বাঙালীকে হতে হয়নি। আর এসব ঘটিয়েছিল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের রাষ্ট্রযন্ত্র তার নিজস্ব জনগণের ওপর এবং ঐ রাষ্ট্রযন্ত্রের কুশীলবরা ছিল মূলত পশ্চিম পাকিস্তানী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে, কিন্তু পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রযন্ত্রের তৎকালীন নীতি নির্ধারকগণ কি মনোভঙ্গীর কারণে ইতিহাসের এই জঘন্যতম অপরাধটি বাঙালীদের ওপর সংঘটিত করল, তাদেরই জবানীতে তা জানতে এবং পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত করে জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ গড়ে ওঠার বাস্তবতায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সম্পর্কে পাকিস্তানের বর্তমান এলিটশ্রেণী, রাজনীতিক, আমলা, সাংবাদিক, শিক্ষক ও গবেষকরা কি দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেন - অত্যন্ত নিবিড় ও অনুপুঙ্খরূপে তা জানার চেষ্টা থেকে এই বইটি রচিত হয়েছে। উপস্থাপিত প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে সাক্ষাৎকার গ্রহণ এই বইটির ভিত্তি। এই বইটিতে বাংলাদেশ অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার জন্য যাঁকে সবচেয়ে বেশী দায়ী করা হয় সেই জুলফিকার আলী ভুট্টোর কিছু ঘনিষ্ঠ সহচর, পূর্ব পাকিস্তানে গনহত্যায় সরাসরি জড়িত কতিপয় জেনারেল ও তাঁদের ঘনিষ্ঠ সহকর্মী প্রাক্তন সিভিল অফিসার, বুদ্ধিজীবী, গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র, রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকারকে অত্যন্ত মনোজ্ঞ অথচ বিশ্বস্তভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক। সাক্ষাৎকারদানকারীদের মধ্যে আছেন ভুট্টোর রাজনৈতিক সহচর রফি রাজা, রাজা কাজেম, মুবাশ্বির হাসান, কামার উল ইসলাম, মেরাজ মোহাম্মদ, সামরিক কর্মকর্তা মে. জে. গুলাম উমর, লে. জে. আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী, লে. জে. সাহেবজাদা ইয়াকুব খান, মে. জে. রাও ফরমান আলী, ব্রিগেডিয়ার এ আর সিদ্দিকী; রাজনীতিক ও রাজনৈতিক কর্মী বেনজীর ভুট্টো, এয়ার মার্শাল আসগর খান, গফুর আহমেদ, ইউসুফ মাস্তে খান, আজহার জামি, ওসমান বালুচ; প্রাক্তন আমলা ড. আফতাব আহমেদ, আলতাফ গওহর, ফারুক আহমদ লেঘারি, হাসান জহির, রোয়েদাদ খান, সৈয়দ আলমদার রাজা; সাংবাদিক এম ভি নকভী, খালেদ আহমদ, আই এ রহমান; এলিট বুদ্ধিজীবী সুহায়েল লারি, তালাত নাজারিয়াত, তাহেরা মাজহার আলী, খালেদ মাহমুদ, আহমদ সেলিম, আখতার হামিদ খান, ড. তারিক রহিম প্রমুখ। বইটির সাফল্য এখানেই যে, লেখক যে বিষয়টিকে পাঠককের সামনে উপস্থিত করতে চেয়েছেন অসংখ্য সাক্ষাৎকারের মধ্যে সেটি আড়াল হয়নি, তিনিও বিচ্যুত হননি নিজ দায়িত্ব থেকে। আর তাই পাঠকও এই বইটি পাঠ করে ১৯৭১ সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে পাকিস্তানী মনোভঙ্গীকে হৃদয়ঙ্গম করতে ন্যূনতম দ্বিধায় পড়বেন না।
মুনতাসীর মামুন
মুনতাসীর মামুনের জন্ম ১৯৫১ সালে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে এম. এ.. পিএইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। লেখালেখি করছেন ১৯৬৩ সাল থেকে। ছাত্রজীবনে জড়িত ছিলেন ছাত্র-আন্দোলনে এবং ১৯৬৯ সাল থেকে এ-পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেছেন প্রতিটি সাংস্কৃতিক ও গণআন্দোলনে। স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম ডাকসু নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন সম্পাদক। একই সময়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি। তাঁর সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয় ডাকসু’র মুখপত্র ছাত্রবার্তা। এছাড়াও বাংলাদেশ লেখক শিবির ও বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়নের ছিলেন তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও যথাক্রমে প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক ও যুগ্ম সম্পাদক। ঢাকা নগর জাদুঘরের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন তিনিও একজন । এছাড়াও তিনি জড়িত বিভিন্ন একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। বাংলাদেশে লেখালেখির জগতে মুনতাসীর মামুন একটি বিশিষ্ট নাম। সমসাময়িককালে তার মতাে পাঠক নন্দিত লেখক খুব কমই আছে। গল্প, কিশােরসাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষণা, চিত্রসমালােচনা, অনুবাদ ইত্যাদিতে তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ ও সেই সাথে রাজনৈতিক ভাষ্যে অর্জন করেছেন বিশেষ খ্যাতি । উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৭০। বাংলা একাডেমী পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার, ড. হিলালী স্বর্ণপদক পুরস্কার, প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৩), মার্কেন্টাইল ব্যাংক স্বর্ণপদক ইত্যাদিতে তিনি সম্মানিত। স্ত্রী ফাতেমা মামুন ছিলেন একজন ব্যাংকার ।