অনুবাদকের কথা সকল প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের উর্দু সাহিত্যের প্রথিতযশা কবি ও খ্যাতিমান ঔপন্যাসিক নসীম হিজাযীর বিখ্যাত উপন্যাস সফেদ জাজিরাহ’র অনুবাদ সফেদ দ্বীপের রাজকন্যা নামে বাংলাভাষী পাঠকদের খেদমতে পেশ করার তওফিক দান করেছেন। বাংলাভাষী সচেতন উপন্যাসপ্রেমীদের কাছে উর্দু সাহিত্যের যশস্বী ও কীর্তিমান ঔপন্যাসিক নসীম হিজাযীকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। কেননা, এরই মধ্যে বহু নামিদামি অনুবাদক তাঁর অসংখ্য মূল্যবান উপন্যাস বঙ্গানুুবাদ করে সুধী পাঠকদের মনে তোলপাড় সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। বাজারে এগুলোর কাটতি দেখে সত্যিই বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। তারই নিরীখে আশান্বিত হয়ে আমরা ‘সফেদ জাজিরাহ’র অনুবাদের কাজ হাতে নিতে সাহস পাই। প্রকৃতপক্ষে আলোচ্য উপন্যাসটি এখন থেকে প্রায় পাঁচ যুগ আগের লেখা। কিন্তু লেখক তাঁর বলিষ্ঠ কল্পনাশক্তি ও ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে এতে উপস্থাপিত বিভিন্ন চরিত্র ও স্থানের নামগুলো উহ্য রেখে এমনভাবে ঘটনাপ্রবাহ উপস্থাপন করেছেন এবং সুধী পাঠকদের মনের জগতে এমন এক আবহ সৃষ্টি করার প্রয়াস পেয়েছেন, যার মাধ্যমে তাঁরা যেন নিজ চোখে দেখতে পাবেন আপন দেশ ও তৃতীয় বিশ্বের পরিচিত পরিবেশ আর অনুভব করবেন যেন তাঁরা পড়ছেন নিজেদের দেশেরই একান্ত বাস্তব কাহিনী। স্বেচ্ছাচারী শাসক কিংবা স্বৈরাচারী সরকার সামরিক বা রাজনৈতিক- যে পর্যায়েরই হোক না কেন, তাদের স্বভাব-চরিত্র, স্বরূপ-প্রকৃতি, মন-মানসিকতা, ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-চেতনা, উদ্যোগ-আয়োজন এবং যাবতীয় কর্মতৎপরতা ও প্রাণচাঞ্চল্য সব কিছুই নিজেদের স্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে থাকে। কেননা, তাদের মনমগজে একটা অজানা অতঙ্ক-আশঙ্কা বিরাজমান থাকে যে, কখন কিভাবে তাদের ক্ষমতার মসনদ উল্টে যায়। এমনকি অযাচিত ও অনাকাক্সিক্ষত কোন পরিস্থিতি কখন সৃষ্টি হয়ে যায়, যাতে তাদের জীবনই হয়ে পড়ে বিপন্ন ও হুমকির সম্মুখীন। তাই সদা ভয়, সদা আতঙ্ক এরূপ পরিবেশেই আরামের ঘুম হারাম করে তারা ক্ষমতার স্বাদ নিতে শুরু করে। তারা তাদের সমমনা স্বার্থপর লোকদের দলে ভিড়িয়ে তাদের দল ভারী করার অযাচিত প্রতিযোগিতায়ও মেতে ওঠে।
বস্তুত যুগে যুগে স্বৈরাচারী শাসকরা কিভাবে তাদের নানামুখী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দেশ ও জাতির অলক্ষ্যে তাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে থাকে আর ‘উড়ে এসে জুড়ে বসে’ পড়ে অসম্পূর্ণ, অপাঙ্ক্তেয় ও অবাঞ্ছিতরূপে। তাদের বন্দুকের নল থেকে ক্ষমতা দখলের পথ সুগম হয়ে থাকে বলে দেশ অথবা দেশের মানুষের কাছে তাদের কোনো রকম দায়বদ্ধতা থাকে না। ফলে তাদের স্বেচ্ছাচারী কার্যকলাপ ও স্বৈরাচারী কর্মতৎপরতায় অসহায় ও নির্বিকার জাতি কিংবা দেশবাসীর তখন কিছুই করার থাকে না। হতভাগা জাতি নিরুপায় হয়ে মুক্তির উপায় খুঁজতে গিয়ে কখনো কোনো বিকল্প ধারা, আবার কখনো তৃতীয় কোনো শক্তি অথবা অন্য কোনো দল বা জোটের অবির্ভাবের জন্য তীর্থের কাকের মতো অধীর আগ্রহে প্রহর গুনতে থাকে। অপরদিকে স্বেচ্ছাচারী পন্থায় ক্ষমতাসীন সংশ্লিষ্ট স্বৈরাচারী সরকারও বিলক্ষণ বুঝতে পারে যে তার পায়ের তলায় কিন্তু মাটি নেই। অর্থাৎ যেহেতু তারা জনগণের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে ক্ষমতার মসনদ দখল করেনি। সুতরাং জনসাধারণ যখনই সুযোগ পাবে, তখনই প্রয়োজনীয় বিদ্রোহ অথবা বিপ্লব ঘটিয়ে স্বৈরাচারের পতন ত্বরান্বিত করতে মোটেও কার্পণ্য করবে না। ফলে তারাও অলৌকিক ক্ষমতা বলে কিংবা তরিকতপন্থীদের পদধুলো ললাটে মেখে যত দিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে রাখা যায়, সে চেষ্টায়ই মেতে ওঠে। আর সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদ, পরগাছা বুদ্ধিজীবী, ভণ্ড তপস্বী ও কপট ঋষীদের পর্যায়ক্রমে দলে ভিড়িয়ে দল ভারী করার রকমারি কলাকৌশল প্রয়োগ করতেও যারপর নাই তারা কোনো কসুর বা দ্বিধা করে না। সব যুগেই সব স্বৈরাচারী সরকারের চরিত্রই এক ও অভিন্ন হয়ে থাকে। তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে থাকে নিজেদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করার দুরভিসন্ধি নিয়ে। সুতরাং ছলে-বলে-কৌশলে সদাসর্বদা তাদের ধান্ধা থাকে কিভাবে তারা সরকারি কোষাগার লুণ্ঠন করে নিয়ে নিজেদের পেট ও পকেট ভারী করতে পারে। স্বনামে কিংবা বেনামে সহায়-সম্পদ ও বিত্ত-বৈভবের পাহাড় গড়ে তুলতে পারে স্বদেশে কিংবা বিদেশের ব্যাংকে। কাঁড়িকাঁড়ি অর্থ হাতিয়ে নিয়ে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি একের পর এক হাতিয়ে নিতে তারা সদাতৎপর হয়ে থাকে। পরিশেষে জনগণের রুদ্ররোষের শিকার হয়ে একসময় তারা দেশ ত্যাগ করে ভিন দেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাতেও কার্পণ্য করে না। বক্ষ্যমাণ উপন্যাসটি পড়লে পাঠক আশা করি এ বিষয়ের বাস্তব একটা চিত্র দেখতে পাবেন। মহান আল্লাহর রহমতে ভবিষ্যতে আরো উন্নত ও রুচিশীল প্রকাশনার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে আমরা সচেষ্ট থাকব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা আমাদের কল্যাণ ও তাকওয়ার পথে দ্রুত অগ্রসর হওয়ার তওফিক দিন। আমিন।