রাখাল (হার্ডকভার)
রাখাল।।।। । হিন্দু ধর্মের ধর্মগ্রন্থ বেদের একটি শব্দের পরিবর্তনের কারনে যুগ যুগ ধরে বিধবা নারীদের স্বামীর সাথে চিতার অাগুনে পুড়ে মরতে হতো। হোক সেটা ইচ্ছায় অথবা অনিচ্ছায়। সেই চিতার অাগুন থেকে বেঁচে যাওয়া এক নারীর হৃদয়বিদারক কাহিনী অবলম্বনে রচিত। পালকীযোগে সাত পাক ঘুরিয়ে পূর্বা দেবীকে চিতায় তোলা হয়েছে। তরাই পরগণার হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে জাঁকজমকপূর্ণ এ অায়োজন দেখতে। পূর্বা দেবী চিতার অাগুনে নিজেকে বলি দিবে ও তার স্বামীকে নিয়ে স্বর্গে যাবে। জমিদার বাড়ির গৌরব অারো উজ্বল করবে, বাবা-মা কে অারো সম্মানে, গুনে গুনান্বিত করবে। সবাই অানন্দিত, উত্তেজিত অনেক দিন পর সতীদাহ দেখবে পূর্বা দেবীর কল্যানে। পূর্বা দেবীর বাবা চিতায় অাগুন দিলেন। অাগুন জ্বলা শুরু করলো। চিতার চারপাশে কিছু লোক জড়ো করা হলো যাতে পূর্বা দেবী অাগুনের যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে বের হয়ে অাসতে না পারে। হঠাৎ তরাই পরগণার ম্যাজিস্ট্রেট পিটারশেন হাজির। পূর্বা দেবীকে দাহ করা যাবে না। চারদিক স্তব্দ হয়ে গেলো.................. রামাদেব ঘোষাল, যিনি পরলোক গমন করেন তার জমিদারিত্বের উত্তরসূরীর মিমাংশা না করেই। এ নিয়ে তার ভাই বাসুদেব ঘোষাল ভীষণ চিন্তিত। তার ইচ্ছা বৌদিকে ভাইয়ের সাথে চিতার অাগুনে বলি দিলে তার ভাইও স্বর্গ পাবে অার তার জমিদার হওয়ার পথে অার বাঁধা থাকলো না। এদিকে পূর্বা দেবী মনস্থির করলেন তিনি তার পতির সাথে চিতার অাগুনে সহমরণ করবেন। কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারেন বাসুদেব তার জমিদারিত্বের জন্য তাকে চিতার অাগুনে তুলে মারতে চান তখন তিনি তার সিদ্ধান্ত থেকে ফিরে অাসেন। কিন্তু কঠিন নিরাপত্তাবেষ্টনী দ্বারা অাবৃত এ জমিদার বাড়ি থেকে কিভাবে পালাবেন। পালিয়ে যেতে তিনি দারস্থ হন তার খাস দাসী কুন্তির কাছে। কৌশলে গভীর রাতে সে পালিয়ে যায় এবং অাশ্রয় নেয় এক মুসলিম রাখালের কাছে। যে রাখাল তাদের গরু,মহিষ পালন করতো। গরু মহিষদের নিয়ে জঙ্গলেই বসবাস করতো। পূর্বা দেবীকে সে এক বিশাল পাহাড়ের গুহায় অাশ্রয় দেন। তাকে নতুন ভাবে বাঁচার সব রশদ জুগিয়ে দেন। এদিকে বাসুদেব ঘোষাল তার অনুসারী ও ঠগীদের দায়িত্ব দেন পূর্বা দেবীকে খুজেঁ বের করার। দুদিন পার হলেও যখন তারা খুঁজে পেতে ব্যর্থ বাধ্য হয়ে বাসুদেব ভাইয়ের পচা লাশ চিতার অাগুনে পুড়ে কবর দিয়ে দেন এবং ঘোষনা দেন পূর্বা দেবীকে খুজেঁ পেলে দাদার লাঠির সাথে তার অনুমরণ করাবেন এমন সব নানা ঘটনা নিয়ে এই বইটি।। এক বসায় পড়ে ফেলার মত বই রাখাল। লেখকের প্রথম পড়া বই। অসাধারন লেগেছে। সুন্দরভাবে প্রতিটি স্থানের বর্ননা দিয়েছে। উপমাগুলো চমৎকার লেগেছে। চরিত্র রুপায়ণে দারুন মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। প্রত্যেকটা চরিত্রকে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়েছেন। আজকেই বইটি পেতে অর্ডার করুন।।
সমসাময়িক সময়ে লেখকদের মাঝে লতিফুল ইসলাম শিবলী অনেকেরই পরিচিত। আমার পড়া উনার লেখা তৃতীয় বই রাখাল। রাখাল পড়ার পর আমার মনে হচ্ছে আমরা বাংলা সাহিত্যে আরো একজন ঔপন্যাসিক পেতে যাচ্ছি। লেখককে একজন সত্যিকারের ঔপন্যাসিক হয়ে উঠার পথে তার এই রাখাল বইটি আরো এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। রাখাল একটি ফিকশন উপন্যাস। এই উপন্যাসটি রচিত হয়েছে আঠারো শতকের তৃতীয় দশকের সময়ের সমাজকে কেন্দ্র করে। তৎকালীন হিন্দু সম্প্রদায়ের একটা জঘন্য প্রথা ছিল সতিদাহ প্রথা। বিশের দশকে এই সতীদাহ প্রথা বন্ধের জন্য রাজা রাম মোহন রায়সহ কিছু হিন্দু সংস্কারক আন্দোলন করছিলেন। তাদের এই আন্দোলনকে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীও সাধুবাদ জানিয়েছিলো। রাখাল উপন্যাসের নারী চরিত্র পূর্বা দেবীও এই কুসংস্কারের বেড়াজালে আটকা পড়েছেন। বৃদ্ধ জমিদার রামদেব ঘোষালের যুবতী স্ত্রী পূর্বা দেবী। অসুস্থ রামদেব ঘোষালের মৃত্যু আসন্ন। কিন্তু তিনি জমিদারির কোন উত্তরাধিকারী রেখে যাননি। ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী নিঃসন্তান জমিদারের মৃত্যুর পর তার জমিদারি চলে যায় তার স্ত্রীর হাতে। তাই তো ঘোষাল মহলে চলছে এক ভয়ংকর ষড়যন্ত্র। রামদেব ঘোষালের ভাই বাসুদেব ঘোষাল তাই পূর্বা দেবীকে তার স্বামীর সাথে সহমরণে দিয়ে জমিদারি আর লোক দেখানো পূণ্য দুটোই অর্জন করতে চান। লেখক এখানে তৎকালীন হিন্দু সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন অবস্থাকে তুলে ধরেছেন। অন্যদিকে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মুসলিম পরিবারের ছেলে রাখাল ঘোষাল মহলের বাথানের পশুর রাখাল। সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না পেলেও পেয়েছে প্রকৃতির থেকে শিক্ষা। তার বাবা তাকে কিভাবে প্রকৃতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় তা শিখায়েছেন। আর তাই সে মানুষের চেয়ে গভীর জঙ্গলে একা একা চড়ে বেড়াতে পছন্দ করে। একা একা থেকে তার মধ্যে একটা দার্শনিক সত্বা তৈরি হয়েছে। সে কখনোই বিপদে বিচলিত হয়ে পরে না। পূর্বা দেবীর দাসী কুন্তী নিরুপায় হয়ে এই রাখালের কাছেই পূর্বা দেবীর জীবন বাঁচানোর জন্য সাহায্য চায়। কারণ কুন্তীর বিচক্ষণ চোখে রাখলকে মনে হয়েছে সে অন্য ধরণের পুরুষ। যার মাঝে সত্যিকারের পৌরুষ আছে। তাই তারই কাছে সাহায্য চায়। রাখাল পূর্বা দেবীকে সাহায্যে এগিয়ে আসে। সে পূর্বা দেবীকে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে। পূর্বা দেবীও ঘোষালদের বদ্ধ মহলের বাইরে এই অপরূপ পৃথিবী দেখে মুগ্ধ হয়, আশ্চর্যিত হয়। এর চেয়েও বেশি আশ্চর্য হয় এই রাখালকে দেখে। তার চেনা পরিচিত পুরুষদের চেয়ে সম্পুর্ন আলাদা এক পুরুষকে সে আবিষ্কার করে। এদিকে তরাই পরগনায় পূর্বা দেবীর রহস্যজনক উধাও হয়ে যাওয়া নিয়ে নানা কল্পনা জল্পনা চলছে। অন্যদিকে এই সহমরণ বন্ধের জন্য রামমোহন রায়ের দলের লোকেরাও বাসুদেব ঘোষালকে নিবৃত করতে চাইছিল। বাসুদেব ঘোষাল ঠগী সর্দারকে খোঁজার কাজে লাগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু রাখালই বা একা কতদিন পূর্বা দেবীকে জঙ্গলে লুকিয়ে রাখতে পারবে? এক টানটান উত্তেজনা নিয়ে পুরো গল্পটা এগিয়ে যায়। কি হবে কি হবে অধির আগ্রহে পড়তে পড়তেই গল্পের সমাপ্তি ঘটে। উপরে উল্লিখিত চরিত্র ছাড়াও গল্পে পুরোহিত অনিল ভট্ট, রামমোহন রায়ের শিষ্য মাধবচন্দ্র ঠগী সর্দার বাহারাম উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। রাখালের নির্ভীকতা, দার্শনিক মনোভাব দেখে মুগ্ধ হয়েছি বারবার। রামদেব ঘোষালের ভাই বাসুদেব ঘোষালের চরিত্রটাও লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে গড়েছেন। বাসুদেব ঘোষালের জমিদারির জন্য লোভী মনোভাব, নৃশংসতা অনেক ইতিহাস মনে করিয়ে দেয়। গল্প বলার ধরন বেশ চমৎকার ছিল। পাঠকের মধ্যে আগ্রহ জাগিয়ে তোলে, চিন্তার জগত খুলে দেয়। গল্পের প্রয়োজনে লেখক কিছু ইতিহাসও তুলে ধরেছেন যা গল্পের ছন্দকে মাধুর্য দিয়েছে। এই উপন্যাসে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে, লেখকের বন জঙ্গলের বর্ণনা। একজন লেখকের লেখা তখনই সফল যখন পাঠকের চোখের সামনে কোন প্রাকৃতিক দৃশ্য পুরোপুরি ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। ছাতিম গাছের তলা, ঈগলের বাসা, গোখরা সাপ, ঝোপ, এসব বর্ণনায় গভীর বনের সৌন্দর্য জীবন্ত হয়ে উঠেছে বইয়ের পাতায়। লেখক এই উপন্যাসে একটা সমাজের ইতিহাসকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সেখানে তিনি সফল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের একটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থাকে লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। যা সাধারণ মানুষের কথা বলে, অন্দরমহলের মেয়েদের মনের কথা বলে। কুন্তী এবং মাধব চন্দ্র চরিত্রকে নিয়ে আরও একটু বিস্তারিত লিখলে ভালো লাগতো। এই দুটো চরিত্রের স্বল্প উপস্থিতি যেন গল্পটাকে একটু অসম্পূর্ণ করেছে। আর এই ধরণের বই একটু বেশি বিস্তৃত হলে ভালো লাগে। এসব সম্মোহনী গল্প শেষ করতে ইচ্ছে করে না। সুনীলের টাইম ট্রিলজি পড়তাম আর আফসোস করতাম। আহা, এমন লেখা শেষ হয়ে গেলে আর কোথায় পাবো? রাখাল পড়ার পর মনে হচ্ছে আমরা আরো একজন ভালো ঔপন্যাসিক পেতে চলেছি। যার লেখা আগ্রহ নিয়ে পড়তে অপেক্ষা করবো। যিনি ইতিহাসের কথা লেখেন, সময়ের কথা লেখেন। লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা তৃতীয় উপন্যাস আসমান পড়ে তার লেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়। আসমান খুবই চমৎকার একটি উপন্যাস ছিল। উনার দ্বিতীয় উপন্যাস দখলও পড়েছিলাম। রাখাল আগের দুইটার চেয়ে পরিণত লেখা মনে হয়েছে। লতিফুল ইসলাম শিবলী বিভিন্ন গুণে গুণান্বিত একজন মানুষ। তার মধ্যে লেখালেখিরও একটা উজ্জ্বল প্রতিভা দেখতে পাচ্ছি। যা দিয়ে তিনি আমাদের কিছু অমূল্য রত্ন উপহার দিতে পারবেন।