এই দর্শন-দারিদ্র্যের দেশে লালন সাঁই বাঙালির এক মহান দার্শনিক প্রতিনিধি। লালন-এই নামটি গভীরভাবে জড়িয়ে আছে লোকায়ত বাঙালির মরমি সাধনা, সংগীত ও জীবনের সঙ্গে। বাংলার অবক্ষয় ও ক্রান্তিকালে তিনি জন্মেছিলেন সংস্কার-জাতপাত ও শাস্ত্রশাসিত এক ধর্মান্ধ সমাজে। আপন অভিজ্ঞতা, উপলব্ধি ও চেতনার মধ্য দিয়ে এই অনুদার পরিবেশকে অগ্রাহ্য ও অতিক্রম করে একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। শাস্ত্র নয়, ধর্ম নয়, ঈশ^র নয়- লালন ভজনা করেছেন মানুষকে, শরণ নিয়েছেন মানবগুরুর- সাম্য-মৈত্রী-প্রেম,-কল্যাণ-মানবতার বন্দনা ধ্বনিত হয়েছে তাঁর গানে গানে।
বাংলার মরমিচেতনার প্রতীক লালন ফকির তাঁর মৃত্যুর পরে তো বটেই বেঁচে থাকতেই অনেক কীর্তিমান বাঙালির শ্রদ্ধা-প্রীতি-মনোযোগ লাভ করেন। তাঁর পরিচিতির পরিধি প্রসারে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর-পরিবারের ভ‚মিকা বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের নাম সবচেয়ে বেশি স্মরণীয়। তাঁর লালনচর্চা নানা তাৎপর্যে মূল্যবান ও গুরুত্ববহ। রবীন্দ্রনাথ লালনের গান সংগ্রহ ও প্রকাশ যেমন করেছেন তেমনি এই মরমি পদকর্তার জীবন, সংগীত ও দর্শন সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। আবার তাঁর মননশীল রচনার মতো সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যকর্মেও লালনের প্রভাব স্পষ্টই পড়েছে। মূলত লালনীয় প্রভাবেই তিনি রূপান্তরিত হয়েছেন ‘রবীন্দ্রবাউল’। আবুল আহসান চৌধুরীর ‘রবীন্দ্রনাথের লালন’ বইয়ে নানা কৌণিকে বাউলসাধনার প্রেক্ষাপটে বর্ণিত বিষয়াবলি উপস্থাপিত ও বিশোষিত হয়েছে। এখানে ভিন্ন এক রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করা যায়, যাঁর লালন-অনুরাগ ও লালন-জ্ঞান বাঙালির মরমি-মনকে আরো শ্রদ্ধেয় ও সন্ধিৎসু করে তোলে।