পিতা পুত্র
বইবাজার মূল্য : ৳ ২২০ (২০% ছাড়ে)
মুদ্রিত মূল্য : ৳ ২৭৫
প্রকাশনী : বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র
বিষয় : অনুবাদ: উপন্যাস
পিতা পুত্র ইভান তুর্গেনিভ অনুবাদ: অরুণ সোম সম্পাদনা: সালেহ মাহমুদ ফুয়াদ . . ইভান তুর্গেনিভের পিতা পুত্র নভেলটা পড়লাম।নভেলটাতে চরিত্রের কোনো ঘনঘটা নেই যদিও বোঝার স্বার্থে বইয়ের শুরুতে চরিত্রগুলোর সংক্ষেপে পরিচয় দেওয়া হয়েছে।যাই হোক,নভেলটা আমার ভালো লেগেছে তার প্রধান কারণ হচ্ছে নভেলের প্রধান চরিত্র বাজারভের জন্যে যে কিনা প্রকৃতপক্ষে একজন নিহিলিস্ট এবং সবকিছু প্রত্যাখ্যান করার স্পর্ধা রাখে।তুর্গেনিভ তাকে কেন্দ্র করেই পুরো নভেলটা সাজাচ্ছে ফলে দেখা যায় যে সে যখন তার বন্ধু আর্কাদির সাথে তাদের বাড়িতে গিয়ে উঠলো তখন জানতে পারলো যে আর্কাদির বাবা নিকলাই পেত্রোভিচ কির্সানভ একজন জমিদার।সুতরাং স্বাভাবিক অর্থেই বাজারভ সেগুলোর তীব্র সমালোচনা করে তবে আর্কাদিও করে কিন্তু তার সমালোচনা কিছুটা তার বাবার প্রতি পক্ষপাতিত্বেরই প্রকাশ পায় মানে পুরোটা বলতে পারে না যেটা পারে বাজারভ এজন্যে সে মোটামুটি সম্মান রেখে একটা অসহ্য চরিত্র হয়ে ওঠে কেননা সে সব যুক্তি দিয়ে খন্ডন করে এবং মোটামুটি সব অস্বীকার করে।বলে রাখা ভালো তুর্গেনিভও ভূমিদাস প্রথা ঘৃণা করতো এবং এজন্যে উনি বাড়িও ছেড়েছিলো। . তবুও নভেলের প্রয়োজনেই যেহেতু আরো চরিত্র দাঁড় করাতে হবে সুতরাং আমাদের সাক্ষাৎ ঘটে নিকোলাই পেত্রোভিচ কির্সানভের বড় ভাই পাভেল পেত্রোভিচ কির্সানভের সাথে।সে পুরো বাজারভের বিপরীত চরিত্র মানে এন্টি-ক্যারেক্টার আরকি যার কাছে শৌর্য-বীর্য ই একটা বড় ভূমিকা রাখে এবং সে একজন সম্মানিত ব্যক্তি বলে মনে করে নিজেকে মানে অভিজাত শ্রেণী আরকি।আসলে বাজারভ যা যা অস্বীকার করে পাভেল পেত্রোভিচ কির্সানভ সে অস্বীকার করাটাকে সমালোচনা করে ফলে একসময় দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এবং তা একটা ভয়ংকর খেলায় গিয়ে থামে মানে দুজন দুজনকে গুলি করার খেলায়।আসলে তুর্গেনিভ চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন যে অভিজাত শ্রেণী যখন প্রশ্নের সম্মুখীন হয় তখন তারা নিজেদের মধ্যে একপ্রকার তাড়না অনুভব করে,অস্থিরতা গড়ে ওঠে,নিজেদের সিদ্ধান্তকেই সঠিক জাহির করার একটা চেষ্টা চলে যেহেতু তারা অভিজাত তারা সেসব অস্বীকার করে ,সবকিছুর ভেতরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার মধ্যে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় ফলে তারা তা মেনে নিতে পারেনা তাইতো পাভেল পেত্রোভিচ কির্সানভ ও বাজারভকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেনি।এখানে উনি বাজারভের এন্টি-ক্যারেক্টার গড়ে ওঠে।ওরা আলোচনা করে,সমালোচনায় মেতে ওঠে আর একসময় ভয়ংকর খেলায় মেতে ওঠে যদিও বুদ্ধিটা ছিলো পাভেলের তবে এতে প্রকৃতপক্ষে কেউই জেতে না পাভেল আহত হয় তবে এর মাধ্যমে তার মধ্যে একপ্রকার নতুন চিন্তার জন্ম হয়।নতুন ভাবের উন্মেষ ঘটে অনেককিছু পরিবর্তন হয় তাইতো আমরা দেখতে নিকোলাই পেত্রোভিচ কির্সানভের প্রথম স্ত্রী যখন মারা যায় আর সে যখন আরেকটা বিয়ে করে তার থেকে কমবয়সী এক মেয়েকে যার নাম ফেনেচকা এবং তাদের ঘরে একটা সন্তান ও হয় যার নাম মিতিয়া এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের এতোদিনের যে ইগোজনিত কারণে পাভেল সে সম্পর্কটাকে স্থায়ীরূপে দেখতে পারে না সে ভয়ংকর খেলার মাধ্যমেই তার মধ্যে পরিবর্তন ঘটে সে নিকোলাইকে ডেকে এনে সব মেনে নেয় আর ফেনেচকাকে বিয়ে করতে বলে আর বাজারভ এই ভাবে নভেলটিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। . তবে সবচে চমৎকার, জটিল এবং মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ের আবির্ভাব ঘটে যখন বাজারভের সাথে দেখা হয় জমিদারনী আন্না সের্গেইয়েভনা ওদিনৎসোভার সাথে তার বন্ধু আর্কাদির মাধ্যমে। প্রথমে আন্নার প্রেমে মূলত পড়ে আর্কাদি কিন্তু ক্রমশ তা বাজারভে রূপান্তরিত হয় এবং আর্কাদির সম্পর্ক গড়ে ওঠে আন্নার ছোট বোন কাতেরিনা সের্গেইয়েভনার সাথে এবং এখান থেকেই একপ্রকার আর্কাদি ক্রমশ বিলুপ্ত হতে থাকে এবং বাজারভ চলে আসে আমাদের স্পটে।আসলে বাজারভের চিন্তার প্রয়োজনেই মানে সেগুলো উপস্থাপন, ভাবা সেসবের খাতিরেই চরিত্রগুলোর আবির্ভাব ঘটে ক্রমে ক্রমে, বিষয়টা চমৎকার কারণ এতে বিন্দুমাত্রও নভেলের গতিপথের যে প্রবাহ,যে স্বাদ তা পাল্টায়না।যে বাজারভ প্রেমের বিরুদ্ধে থাকে,রোমান্টিসিজমের বিরুদ্ধে থাকে তাকেও আন্নার প্রেমে পড়তে হয় এবং তা অত্যন্ত সরল অথচ তীব্রভাবে তাতে কোনো হিপোক্রেসি থাকে না সে তার যুক্তি দিয়েই সেটাকে বিচার করে।এবং নভেলটিতে একটা দীর্ঘ কথোপকথন থাকে এই বাজারভ ও আন্নার মধ্যে যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য হয়ে ওঠে নভেলটির জন্যে। আন্নাও প্রেমে পড়ে কিন্তু তা মোটেও বাজারভের মতো নয় তার আক্ষেপ থাকে,কষ্ট থাকে,নতুন করে পাওয়ার বাসনা থাকে(যেহেতু সে বিধবা) কিন্তু প্রকাশ ঘটে অত্যন্ত নির্লিপ্ত ভাবে আর এজন্যই যখন বাজারভ একজন আন্নার প্রতি ভালোবাসার কথা বলে তখন সে নিজেকে অই পরিস্থিতিতেও সামলে নেয় আর আরেকটা কারণ হয়ে ওঠে সে জমিদারনী সুতরাং তার জীবন চলে একটা চক্রের ভেতরে মানে রুলস এ্যান্ড রেগুলেশনের ভেতরে আর বাজারভ তো সেসব মানে না এইভাবে আটকে থাকে,পরাধীনতার ভেতরে সুতরাং আন্নার ভালোবাসা হয়ে ওঠে মুগ্ধতা এবং বাজারভকে এটাকে কি বলে-মিস করা?হ্যাঁ -সেটার ভেতরে।তাকে নিয়ে ভাবনার ভেতরে।এখানেও বাজারভ একপ্রকার আঘাত রাখে যদিও সে আরেকটা আঘাত রাখে পাভেল পেত্রোভিচ কির্সানভের ভেতরে বাগানে তার ভাই নিকোলাই পেত্রোভিচ কির্সানভের স্ত্রী ফেনেচকাকে চুমু খাওয়ার ভেতরে।আর এজন্যেই পাভেল অই ভয়ংকর খেলা খেলার সিদ্ধান্ত নেয় কারণ তার মধ্যেও কাউকে না পাওয়ার আক্ষেপ বিরাজ করে। . নভেলটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো বাজারভের বাড়ি ফিরে যাওয়া এবং সেখানে তার বাবা-মায়ের সাথে সাক্ষাৎ লাভ তবে তারা তাদের পুত্রকে নিয়ে একটু বেশিই উল্লসিত থাকে তবে সে উল্লাস বাজারভের একটু অপছন্দই বটে তাইতো তারা তা দূর থেকে উদযাপন করে কারণ পুত্র অনেকদিন পর ফিরে এসেছে। তারা তার মধ্যে একপ্রকার সম্ভাবনা দেখতে পায় এবং তা নিয়ে গর্ব করে আর তাইতো আর্কাদিকে তারা প্রশ্ন করে।বাজারভের সম্পর্কে তার অভিমত কী। আসলে ভূমিদাসপ্রথা তখন স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো আর বাজারভ সেখানেই এসে আঘাত করে,সে রাশিয়ার সমাজব্যবস্থার বিপরীতে গিয়ে দাঁড়ায় ফলে এক সম্ভাবনা গড়ে ওঠেও তা নিভে যায় এবং নিভে যায় অত্যন্ত নির্মম ভাবে-সে অভিজাত সম্প্রদায়ের উদারনীতিকেও সমালোচনা করে যার প্রতিনিধিত্ব করে নিকোলাই ও পাভেল।সুতরাং এইভাবে তার বেঁচে থাকা হয়তো অসম্ভবই হয়ে উঠে তাইতো মৃত্যুর আগ মুহূর্তে সে আন্নাকে বলে ওঠে, 'রাশিয়া আমাকে চায়...না,স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি চায় না।কিন্তু চায় কাকে? তার চাই মুচি, চাই দরজি, চাই কসাই...মাংস বেচে...কসাই...দাঁড়ান,আমি সব গুলিয়ে ফেলছি।এখানে আছে একটা বন...' এভাবে প্রশ্ন রেখে এবং সেটার যথাসম্ভব উত্তর রেখে এমন সম্ভাবনাময় বাজারভের মৃত্যু ঘটে।যে ব্যবস্থায় গুণের কিংবা গুণীর কদর নেই আর তার বাবা-মা পাগলের মতো হয়ে ওঠে।একটা প্রজন্মের আশা-আকাঙ্খার সমাপ্তি ঘটে পাঠকের মধ্যে নতুন চিন্তার স্ফূরণ ঘটিয়ে।বাজারভ মরে গিয়েই প্রভাব বিস্তার করে সবার মাঝে। . যদিও উপন্যাসটিকে সমালোচনা করতে গিয়ে সমালোচক পিসারেভ বলেছেন যে, 'বাজারভ কীভাবে জীবনযাপন করছেন এবং কীকাজ করছেন তুর্গেনিভের পক্ষে তা দেখানো সম্ভব নয় বলেই তিনি আমাদের দেখিয়েছেন কী ভাবে তিনি মারা যাচ্ছেন। ' তিনি আরো বলেছেন, 'বাজারভ যেভাবে মারা গেছেন সেভাবে মরতে পারা মহৎ কীর্তি স্থাপন করা ছাড়া আর কিছু নয়।...' . যেকোনো বইয়ের ব্যাপারে লিখে রাখা নিজের জন্যেই যাতে পরবর্তীতে আবার পাঠে তা সামনে নতুন ধারণার জন্ম দিতে পারে আপাতত আমার পিতা পুত্র পাঠ এটুকুই। পরে আবার সাক্ষাৎ ঘটবে ইভান তুর্গেনিভের সাথে। #বইবাজার_রিভিউ_প্রতিযোগিতা_মার্চ_২০১৯