পায়ের তলায় এসে দাঁড়িয়েছে পথ লিখেছেন খালেদ হোসাইন তিনি সাহিত্যিক, বর্তমানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।
মনস্ক পাঠক জানেন, এসব কবিতা গোপন ও নীরব সাধনার ফল। কবিতায় কী যে খুঁজে ফিরছেন খালেদ হোসাইন অথবা কী যে গেঁথে দিতে তিনি চান কবিতার মর্মমূলে, অথবা কবিতা কীভাবে তুর্কি-নাচন নাচিয়ে তাঁকে অস্থির করে তুলছে গ্রন্থের পর গ্রন্থে, তা সাম্প্রতিক বালা কবিতার এক লক্ষণীয় বিষয়।আমি স্বদেশের জরায়ুতে মিশে থাকি। দৃশ্যগুলাে ডেকে ডেকে আমাকে জাগায়। আশ্বিনের ইন্দ্রিয় জানে মধ্যগাঙ, বৃষ্টিনাদ, কাঁঠালিচম্পার মাদকতা। রােমকূপে উড়ে আসে জারুলের আত্মমগ্ন ছায়া। মানুষের চোখে তবু লেগে থাকে কাদামাখা শ্রাবণের ধারা। দিনান্তের অনুভূতি সমুদ্র-ভ্রমণ শেষে ফিরে আসে এই জনপদে। অনেক হৃদয়ের ভার বুকে নিয়ে রাত্রির নিসর্গে আমি ভাবি-তুমি এক গহিন জঙ্গলের প্রান্ত, যা জলের দুধরঙা মােহনীয়তায় হৃদয়ের ঘরে নিয়ে আসে আসন্নপ্রসবা লবঙ্গ-সৌরভ আর সমুদ্র-নীল দ্বীপের মতাে উজ্জ্বল দিন। পায়ের তলায় এসে দাঁড়িয়েছে পথ প্রণয়ের স্তব নয়, মাহাত্ম্য নয়, প্রণয়ের মর্মার্থও নয়- খালেদ হোসাইনের প্রণয়- অভিজ্ঞতা, প্রীতি যাপনের এক ঝলকের অন্ধ মুহুর্ত, অথবা সম্পর্কসেতুর নিঃশব্দ ভাঙন। আর এ-সবেরই সহগামী ষড়যন্ত্রের ‘বিষমাখা শর’, সিসমহলে নৃত্যরত ‘ডাইনির মেয়ে’, ‘কঙ্কালের বাঘ’, ‘দক্ষ বেদেনী’, ‘লেলিহার প্রস্তরফলক, তেমনি ‘স্বপ্নবাড়ি,’ ‘আকাঙ্ক্ষা পিদিম’, ‘সূর্যমগ্ন জলকুমারী’ এবং ‘স্বপ্নধূলি’। পায়ের তলায় এসে দাঁড়ানো প্রণয়ের এই সব পথে খালেদ হোসাইন গেঁথে দিয়েছেন সমস্ত বিরহভার, আকাঙ্ক্ষার উড্ডীন উচ্ছ্বাস, কখনোবা নিঃসায় সমর্পণ- তোমার কিছুই আমি জানি না, দয়াল, তুমি এত ভালো, আমি ঘর খোলা রেখে চলে যাই/ বিপরীত মেরুতে আর তুমি আমার দুয়ারে এসে বসে থাক, আমি খুঁজে ফিরি তোমাকেই। মূলত দশ দিক মন্থন করে এই কবি খুঁজে দেখেন প্রণয় আর জীবনের সরব সহজতা; তবু সহজ হল না কোনো-কিছু। স্বচ্ছ সমীকরণ নেই বলে কবিও জড়িয়ে যান দ্বৈরথে- এ দ্বৈরথ নিজের সঙ্গে নিজের, দয়িতার, জগত-সংসারের কবিতার ভাষাও তাই পরিগ্রহ করেতে তর্ক-উপযোগী গদ্যভাষা
খালেদ হোসাইন
খালেদ হােসাইন। জন্ম: ১৯৬৪। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। মা: সুফিয়া খাতুন। বাবা: গােলজার
হােসাইন।
ছেলেবেলায় বড়বােনের হাত ধরে বেড়াতে যেতেন। পরীদের বাড়ি। আকাশে পুঞ্জীভূত মেঘের সাদায় রবীন্দ্রনাথকে দেখে বিহ্বল হয়ে পড়তেন, কৈশােরেই। বুকে বেদনার বীজ বুনে দিয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশ। মা কবিতা লিখতেন, আর স্বপ্ন দেখতেন। একটা স্বপ্ন ছিল, এই ছেলে কবি হবে। খালেদ হেসাইনের কবিতার জগতটি ক্রমাগত রহস্যময় হয়ে উঠছে। তিন দশক পরিব্যাপ্ত কাব্যসাধনার ফসল। ইলা মিত্র ও অন্যান্য কবিতা' (২০০০), ‘শিকারযাত্রার আয়ােজন' (২০০৫) ও জলছবির ক্যানভাস (২০০৬)। পাতাদের সংসার (২০০৭), এক দুপুরের। ঢেউ (২০০৮)। সংখ্যা খুব বেশি নয়, তবে বৈচিত্রভাস্বর। ব্যক্তিগত রােমান্টিকতা প্রসারিত হয়ে স্বদেশ-স্বকাল ছাপিয়ে সর্বজনীন ও সার্বভৌম হয়ে উঠছে। কবিতার অন্তর্গত শিরা-উপশিরার রক্তবদলই কেবল নয়, প্রাকরণিক নানা নিরীক্ষায়ও তিনি কবিতাকে স্বতন্ত্র করে তুলেছেন। খালেদ হােসাইনের কবিতাকে চেনা যায়। লেখকের ধাতটা আলাদা, কবিতার জাতটাও আলাদা। ভালােবেসে বিয়ে করেছেন আইরীন পারভীনকে, যিনি একটি কলেজে শিক্ষক। মেয়ের নাম রােদেলা। সুকৃতি, ছেলে অভীতি রৌদ্র। খালেদ হােসাইনের নেশা ভ্রমণ, স্বভাবে ঘরকুনে। পেশায় তিনি বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।