ত্রিশােত্তর বাংলা কথাসাহিত্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একেবারেই দলছুট ও স্বতন্ত্র। পথের পাঁচালী তাঁর প্রথম উপন্যাস। সাহিত্যপত্রিকা বিচিত্রায় এটি প্রথম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় (আষাঢ় ১৩৩৫ থেকে আশ্বিন ১৩৩৬) । গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে বিচিত্রায় প্রদত্ত বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে। ..প্রকৃতির স্বাধীন আবহাওয়া একটি শিশু-চিত্তকে কিভাবে ধীরে ধীরে সংসার-সংগ্রামের উপযােগী করিয়া তুলিতেছে তাহারই বিচিত্র ইতিহাস অপরূপ ভঙ্গিতে। বলা হইয়াছে। শিশু-মনের দুৰ্জ্জেয় রহস্য ইতিপূর্বে আর কেহ এদেশে এরূপ ভাবে উদঘাটিত করেন নাই; অন্য দেশেও কেহ করিয়াছেন কিনা আমাদের জানা নাই। রবীন্দ্রনাথের মতে, “বইখানা দাড়িয়ে আছে আপন। সত্যের জোরে। এর থেকে শিক্ষা হয়নি কিছুই। দেখা হয়েছে অনেক যা পূর্বে এমন করে দেখিনি। বাংলা সাহিত্যের বুদ্ধিবাদী ব্যক্তিত্ব ধূর্জটিপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় এ-উপন্যাস প্রসঙ্গে আবেগােচ্ছাস গােপন করেই বলেছেন- ‘বইখানি আমি অন্তত দুবার পড়লাম। এখনাে আমার মতামত সংযত করতে পারলুম না।...এমন ভাষা, এমন গাম্ভীর্য, এমন nature study, এমন সূক্ষ্মদৃষ্টি, এমন চরিত্রাংশ, এমন পবিত্রতা আমাদের সাহিত্যে দুর্লভ। হয়তাে এসব কারণেই বিচিত্রায় প্রকাশকালে এর গ্রাহক-পাঠকেরা কোনােরকম দ্বিধা না রেখেই বলেছেন- পথের পাচালী শেষ হয়ে গেলে তারা আর বিচিত্রা পড়বেন না ।
যুগবাঞ্ছিত কোনাে প্রতিকার-প্রতিরােধের বয়ান-বিবৃতি নয় পথের পাচালী; তবু সমকালীন রসগ্রাহী বাঙালি পাঠক এর মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছেন আত্মপ্রতিকৃতি, অনুভব করেছেন আত্মীয়তার আস্বাদ। অপু নামক এক গরিব-ঘরের ছেলে কীভাবে নানা প্রতিকূল পথ ডিঙিয়ে জীবনামৃত আস্বাদন করে চলেছে, জীবনপথের বিচিত্র প্রতিবন্ধকতা যে তার উত্তরণে বাধা হয়ে ওঠেনি তারই অসাধারণ বাণীরূপ এটি। মূলত অন্তর্লোকে সদিচ্ছা থাকলে কোনাে মানবপুত্রের জীবনান্বেষা যে ব্যর্থ নয়। বরং সে হয়ে উঠতে পারে অমৃতলােকের অভিযাত্রিক তা এ-উপন্যাসে অপরূপ কথামালায় বিন্যস্ত করেছেন ঔপন্যাসিক। এই অসাধারণ আখ্যানের কারণেই পথের পাঁচালী বাংলা কথাসাহিত্যের ভুবনে একক ও অদ্বিতীয়। এর দ্বিতীয় তুলনা যথার্থই বিরল।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১২ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৪ - ১লা সেপ্টেম্বর,১৯৫০) ছিলেন একজন জনপ্রিয় ভারতীয়বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তিনি মূলত উপন্যাস ও ছোটগল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেন। পথের পাঁচালী ও অপরাজিত তাঁর সবচেয়ে বেশি পরিচিত উপন্যাস। অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যে আরণ্যক, আদর্শ হিন্দু হোটেল, ইছামতী ও অশনি সংকেত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উপন্যাসের পাশাপাশি বিভূতিভূষণ প্রায় ২০টি গল্পগ্রন্থ, কয়েকটি কিশোরপাঠ্য উপন্যাস ও কয়েকটি ভ্রমণকাহিনী এবং দিনলিপিও রচনা করেন। বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ রায়পরিচালিত চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। ১৯৫১ সালে ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার রবীন্দ্র পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন।