১৯৬২ সালে ভারতের সকল জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, সে বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে পাঁচটায় পৃথিবী থেকে জীবনের অবসান ঘটবে। কারণ ওই নির্দিষ্ট মুহূর্তে আটটি গ্রহ একত্রে মিলিত হবে, যাকে তারা বলেছিল ‘অন্তগ্রহ'। প্রার্থনা উচ্চারণের মধ্যে ‘হাভান কুণ্ডে' টনে টনে ঘি জ্বালানো হয়েছিল। স্কুল- কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। বাস, ট্রেন ও বিমান ছিল যাত্রীশূন্য। লোকজন যার যার বাড়িতে পরিবারের সকল সদস্যদের সাথে অবস্থান করে উৎকণ্ঠিতভাবে অপেক্ষা করেছে প্রলয়ের। ৩ ফেব্রুয়ারি আসে এবং অতিবাহিত হয়। কোনোকিছুই ঘটেনি। সমগ্র পৃথিবী আমাদেরকে নিয়ে হাসি ঠাট্টা করেছে। আমি আশা করেছিলাম যে এই অভিজ্ঞতা ভারতীয়দেরকে শেষ পর্যন্ত জ্যোতিষ শাস্ত্র এবং ভবিষ্যদ্বাণী করার অনুরূপ অন্যান্য হাস্যকর পদ্ধতি—হস্তরেখাবিদ্যা, সংখ্যাতত্ত্ব, মণিরত্ন বিষয়ক বিদ্যা এবং আরো কতো কী—এসবের প্রতি বিশ্বাস থেকে মুক্ত করবে। আমার আশা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। হস্তরেখাবিদ্যার ওপর বিশ্বাসের যেন পুনর্জাগরণ হয়েছে, একই সাথে গোঁড়ামি ও অসহনশীলতা যেন প্রবল জোয়ারের রূপ নিয়েছে। ব্যক্তিগত উন্নতি সাধনের লক্ষ্যে মুখোশে পরিণত হয়েছে অতি ধার্মিকতা। ভারত ধীরে ধীরে পরিণত হতে যাচ্ছে একটি প্রতারক ও ভণ্ডদের দেশে। আমি এই গল্পগুলো লিখতে শুরু করেছিলাম দুবছর আগে, যখন যুক্তিহীনতা ও নিজেদের সাধু মনে করার প্রবণতার সাথে আমার ধৈর্যের পাত্র কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। -- খুশবন্ত সিং
খুশবন্ত সিং
খ্যাতিমান ব্যক্তিদের আত্মজীবনীও সাধারণভাবে একঘেঁয়ে ও ব্যাপকভাবে বিরক্তিকর। কারণ আত্মজীবনীর লেখকরা নিজেদেরকে তারা যা ছিলেন প্রায় ক্ষেত্রেই তার চেয়ে বড় দেখাতে চেষ্টা করেন এবং চারপাশে সংঘটিত সবকিছুর সাথে নিজের ভূমিকাকে প্রধান করে তােলেন । কিন্তু খুশবন্ত সিং এর আত্মজীবনী টুথ লাভ অ্যান্ড অ্যা লিটল ম্যালিস এর ব্যতিক্রম । ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভক্তির উপর তার ট্রেন টু পাকিস্তান’ কালজয়ী এক উপন্যাস যেটি ১৯৫৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং ছয় দশক পরও এটি জনপ্রিয় একটি উপন্যাস। খুশবন্ত সিং-এর পরিবার নয়াদিল্লির অন্যতম নির্মাতা। আত্মজীবনীতে পারিবারিক ইতিহাস ও স্মৃতিচারণ ছাড়া উঠে এসেছে লন্ডনের কিংস কলেজে তার যাপিত সময় লাহােরে আইন ব্যবসা পদশভাগ, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যােগদান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সম্পর্কের বিষয়গুলাে । আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উল্লেখযােগ্য ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন কাছে থেকে। নিজের জীবনী লিখতে তিনি নিজের ত্রুটিবিচ্যুতি আড়াল করেননি এমনকি নিজের প্রথম ব্যর্থ যৌন উদ্যোগের ঘটনাও পাঠকদের জানিয়েছেন । ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র সঞ্জয় গান্ধী বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর তার স্ত্রী মানেকার সাথে ইন্দিরা গান্ধীর বৈরি সম্পর্কের একটি অধ্যায় আত্মজীবনী প্রকাশিত হওয়ার আগেই সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ইন্ডিয়া টুডে প্রকাশ করে । মানেকা গান্ধী এর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেন এবং আদালত খুশবন্ত সিং-এর আত্মজীবনী প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করলে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর্যন্ত স্থগিত থাকে গ্রন্থটির প্রকাশনা। প্রকাশনা বিলম্বিত হলেও আদালত লেখকের মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে সীমারেখা টেনে দেয়নি। খুশবন্ত সিং এর উপন্যাস পাঠকরা যেমন রুদ্ধশ্বাসে পড়েন তার আত্মজীবনীও একইভাবে পাঠককে টেনে নিয়ে যায় এক ঘটনা থেকে আরেক ঘটনায় । টুথ লাভ অ্যান্ড অ্যা লিটল ম্যালিস ভারতে প্রকাশিত হওয়ার এক বছর পরই ২০০৩ সালে এটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সালে নালন্দা প্রকাশনী' এটির নতুন সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়।