ফ্ল্যাপের কিছু কথাঃ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ তিনটি-বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারত।বাংলাদেশ ও ভারতের যুক্ততা নিয়ে বই/প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের শত্রুপক্ষ পাকিস্তান নিয়ে কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের নীতি নির্ধারকরা কী ভেবেছিলেন কেন অন্য অংশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন বা কারা করেছিলেন, বাঙালিদের বিরুদ্ধে তাদের মনোভাব কী ছিল সে সম্পর্কিত রচনার সংখ্যা খুবই কম। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই ঘাটতি পুরণে অগ্রসর হয়েছেন মুনতাসীর মামুন।ইতোমধ্যে এ বিষয়ে ড. মামুনের তিনটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় প্রকাশিত হলো ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুনের বর্তমান গ্রন্থ পাকিস্তানি জেনারেলদের ও সংশ্লিষ্ট ২১টি গ্রন্থ/আত্মজীবনী এ গ্রন্থের ভিত্তি।ড. মামুন দেখিয়েছেন, পাকিস্তানি জেনারেলরা গণহত্যা ও বাঙালি দমনের যে যৌক্তিকতা তুলে ধরেছেন বা যে তাত্ত্বিক কাঠামো তুলে ধরেছেন তা এক ধরনের চালাকি বা মিথ্যাচার। শুধু তাই নয় আলোকপাত করেছেন অনেক অনালোচিত বিষয়েও। এই ক্ষেত্রে পথিকৃত ড. মামুন তাঁর বর্তমান গ্রন্থ এক নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।গবেষণায় এনে দিয়েছেন সাহিত্যের স্বাদ।এক কথায় মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত গ্রন্থের তালিকায় বর্তমান গ্রন্থ এক অনন্য সংযোজন। ভূমিকা ১৯৯৮ সালে আমি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত গবেষণার জন্য পাকিস্তান যাই এবং প্রায় একমাস প্রকাশক জনাব মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রায় ৩৫ জন নীতি নিধারক ও বিভিন্ন শ্রেণী/পেশার মানুষের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। এ ক্ষেত্রে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেসের প্রধান আমেনা সাঈদের সাহায্য না পেলে প্রায় কিছুই করা সম্ভব হতো না।ফিরে এসে আমি পাকিস্তান সম্পর্কিত দৃটি বই প্রকাশ করি-সেই সব পাকিস্তানি ও পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেলদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ [এর ইংরেজি অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে] উল্লেখ্য শেষোক্ত গ্রন্থটির ৭টি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল।পরাজিত পাকিস্তানি...... ছিল ৪টি প্রবন্ধের সংকলন। এর মধ্যে দীর্ঘতম প্রবন্ধটি ছিল ‘ পরাজিত পাকিস্তানি জেনারেলদের দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ।’ পাকিস্তানে বিভিন্ন ভ্রমণের সময় পাকিস্তানি জেনারেলদের বেশ কিছু আত্মজীবনী চোখে পড়ে।সেগুলো সংগ্রহ করে পড়ে ফেলি এবং মনে হয় ঐসব গ্রন্থে যেসব মিথ্যাচার আছে সেগুলোর প্রতিবাদ হওয়া উচিত। সে কারনেই প্রবন্ধটি রচনা করি।প্রবন্ধটির ভিত্তি ছিল ৭টি প্রন্থ।১৯৯৮ থেকে পরবর্তী দশ বছর পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে জেনারেলদের লেখা আরো ১৪টি বই যোগাড় করি।আমার মনে হয়েছে, পাকিস্তানে জেনারেলরা ১৯৭১ সম্পর্কে যে তাত্ত্বিক কাঠামোর সৃষ্টি করেছেন যার ভিত্তি মিথ্যাচার, তার বিশ্লেষণ করা উচিত। এ পরিপ্রেক্ষিতেই মোট ২১টি বইয়ের ওপর ভিত্তি করে বর্তমান গ্রন্থটি রচনা করেছি। এর মধ্যে তিনটি বই ইতিহাস সংক্রান্ত, একটি কমিশনের রিপোর্ট, বাকীগুলি আত্মজীবনী। এর বাইরেও যে দু-একটি বই নেই, তা নয়। তবে, আমার মনে হয় তাতেও আমরা যে তাত্ত্বিক ফ্রেম তৈরি করেছি ও যে উপসংহারে পৌঁছেছি তার হেরফের হবে না। এ বিষয়ে এটিই প্রথম বই।সুতরাং, ভূল-ত্রুটি থাকতেই পারে।পাঠকরা পরামর্শ দিলে তা শুধরে নেব। এ গ্রন্থে সম্পূর্ণতা আনার জন্য আমার ও মহিউদ্দিন আহমদের নেয়া বেশ কটি সাক্ষাৎকারেও সংকলন করছি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পরাজিত পাকিস্তানি----- গন্থের ৭টি পরিশিষ্ট।ইতিহাসের কারণে, এসব পরিশিষ্ট সংযোজন প্রয়োজন বলে আমার মনে হয়েছে। পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবীরা ১৯৭১ সাল সম্পর্কে কী ভাবছেন, তাদের নিবন্ধে তা বোঝা যাবে। এখানে উল্লেখ্য, পরাজিত পাকিস্তানি ......... র আর কোনো সংস্করণ প্রকাশিত হবে না।প্রায় এক দশক আগে কাজটি শুরু করেছিলাম। এখন তা শেষ করতে পেরে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে, একটি কর্তব্য কর্ম সমাপন করলাম। পাণ্ডুলিপি রচনার সময় কলকাতার ‘মওলানা আবদুল কালাম আজাদ ইন্সটিটিউট অব সাইথ এশিয়ান স্টাডিজ’ স্বল্প সময়ের জন্য একটি ফেলোশিপ প্রদান করেছিল। ফলে কাজটি দ্রুত এগিয়েছে। এর জন্য ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জয়ন্ত কুমার রায়কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ধন্যবাদ জানাচ্ছি বন্ধু আহমেদ মাহফুজুল হক ও আমাদের বিভাগের গবেষণারত ছাত্রী মুর্শিদা বিনতে রহমান-কে যিনি প্রুফ দেখার ও শব্দসূচি তৈরীতে সহায়তা করেছেন এবং ফরিদ আহমেদকে যিনি দ্বিধা না করে আমার যে কোন গ্রন্থ প্রকাশে প্রস্তুত। ১৯৯৯-২০০০ সালে পাকিস্তানিদের সহযোগী রাজাকারদের নিয়ে আমি দু’খণ্ডে একটি বই লিখি, নাম রাজাকারের মন।সে বইয়ে একই ভাবে রাজাকারদের লেখা বিশ্লেষণ করে যেসব সিদ্ধান্তে পৌছেছিলাম তার সঙ্গে বর্তমান গ্রন্থের জেনারেলদের মনের আশ্চর্য মিল দেখতে পাচ্ছি। একদিক থেকে দেখতে গেলে গ্রন্থ পরস্পরের পরিপুরক। মুনতাসীর মামুন ইতিহাস বিভাগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০১০
মুনতাসীর মামুন
মুনতাসীর মামুনের জন্ম ১৯৫১ সালে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে এম. এ.. পিএইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করেছেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক। লেখালেখি করছেন ১৯৬৩ সাল থেকে। ছাত্রজীবনে জড়িত ছিলেন ছাত্র-আন্দোলনে এবং ১৯৬৯ সাল থেকে এ-পর্যন্ত অংশগ্রহণ করেছেন প্রতিটি সাংস্কৃতিক ও গণআন্দোলনে। স্বাধীন বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত প্রথম ডাকসু নির্বাচনে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন সম্পাদক। একই সময়ে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃতি সংসদের সভাপতি। তাঁর সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয় ডাকসু’র মুখপত্র ছাত্রবার্তা। এছাড়াও বাংলাদেশ লেখক শিবির ও বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়নের ছিলেন তিনি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও যথাক্রমে প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক ও যুগ্ম সম্পাদক। ঢাকা নগর জাদুঘরের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন তিনিও একজন । এছাড়াও তিনি জড়িত বিভিন্ন একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। বাংলাদেশে লেখালেখির জগতে মুনতাসীর মামুন একটি বিশিষ্ট নাম। সমসাময়িককালে তার মতাে পাঠক নন্দিত লেখক খুব কমই আছে। গল্প, কিশােরসাহিত্য, প্রবন্ধ, গবেষণা, চিত্রসমালােচনা, অনুবাদ ইত্যাদিতে তার স্বচ্ছন্দ বিচরণ ও সেই সাথে রাজনৈতিক ভাষ্যে অর্জন করেছেন বিশেষ খ্যাতি । উল্লিখিত প্রতিটি ক্ষেত্রেই তার একাধিক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ১৭০। বাংলা একাডেমী পুরস্কার, লেখক শিবির পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক পুরস্কার, ড. হিলালী স্বর্ণপদক পুরস্কার, প্রেসিডেন্ট পুরস্কার (১৯৬৩), মার্কেন্টাইল ব্যাংক স্বর্ণপদক ইত্যাদিতে তিনি সম্মানিত। স্ত্রী ফাতেমা মামুন ছিলেন একজন ব্যাংকার ।
Title :
পাকিস্তানি জেনারেলদের মন : বাঙালি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ