আমেরিকানরা যুদ্ধের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশটি থেকে গুটিয়ে নিচ্ছে নিজেদের এবং আফগান যোদ্ধারা দলে দলে এসে ঢুকছে রাজধানীর সীমানায়। আল-জাজিরার পক্ষ থেকে আমাকে পাঠানো হচ্ছে পুরো বিষয়টি কাভার করার জন্য। টের পাচ্ছিলাম, সাংবাদিকতার ইতিহাসে সবার আগে এমন কিছু সংবাদ আমি লিখতে যাচ্ছি, যা শুধু সংবাদই নয়, জলজ্যান্ত ইতিহাস এবং এ ইতিহাস থেকে যাবে বহু কাল! আমি সাংবাদিকের তীক্ষ্ম দুটো চোখ নিয়ে মহাকালের বিচিত্র সে অঞ্চলটির গ্রামেগঞ্জে হন্যে হয়ে ঘুরছিলাম আর ভিতরে সৃষ্টি হচ্ছিল অসম্ভব এক উত্তেজনা! এ উত্তেজনার সংগত কারণ আছে। একটি সভ্যতা তার নতুন যৌবনটি অতিক্রম করছে; এমন অভূতপূর্ব এক সময়ের মুখোমুখি হলে উত্তাল হয়ে উঠবেন যে কোনো ঐতিহাসিক বা ইতিহাসপাঠক। আফগানিস্তান তো মাটি আর পাথরের ধূসর একটি ভূমি নয় কেবল, নয় ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে-যাওয়া দ্রষ্টব্যহীন অগুরুত্বপূর্ণ কোনো দেশ; এ বরং সর্বদাই ছিল আলোচিত এক বিস্ময়-প্রান্তর, যা একই সাথে মানুষের মুক্তি ও দুর্ভোগ, মানবতার অনুপম ছবি ও শয়তানের ছড়িয়ে-দেওয়া গভীর অন্ধকার—সকল কিছুর অদ্ভুত লীলাভূমি!
.
সমকালীন আফগানকে বুঝতে হলে, নিকট ইতিহাসকে সত্যের পাটাতনে দাঁড়িয়ে দেখতে হলে এবং তালেবানদের সাহসিকতা, বৈশিষ্ট্য ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো সে ভূমিতে পরাস্ত হওয়ার রহস্যকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হলে এ বই অবশ্যপাঠ্য। নিকট আফগান নিয়ে যারা গবেষণা করবেন, তারা বইটি অতিক্রম করে যেতে পারবেন না, বলাই বাহুল্য।
বইটি আপন জায়গায় অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এর ভাষা ও বক্তব্যের শৈল্পিক বিন্যাস। ফলে পাঠ শেষ করার পর সব বুঝে নিয়েও এর জনরা নিশ্চিত করতে গিয়ে পাঠক একটি সানন্দ বিভ্রমে পতিত হবেন, এটুকু নিশ্চিত করেই বলা যায়! কারণ, বইটিতে ইতিহাসের বিবরণ আছে, বর্তমানের ছবি আছে, আছে একান্ত অনুভবে ইতিহাস ও বর্তমানের সেতুবন্ধনকারী চিন্তা, বিশ্লেষণ ও অবলোকনের সারবত্তা। এসেছে আফগান সমাজের ছবি, চরিত্র ও প্রবণতা, সময়ের বাঁকবদল, উত্থান-পতনের নেপথ্য-কারণ। এবং সব কিছু তিনি বিবৃত করেছেন অ্যাডভেঞ্চারের কাঁপন, ফিকশনের আনন্দ ও ইতিহাসের নির্মোহ বিবৃতির মিশেলে ভাবসমৃদ্ধ অদ্ভুত এক সরল ভাষায়। ফলে পাঠক যখন বইয়ের সর্বপ্রথম অংশটিতেই পাঠ করেন—‘১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। আফগানিস্তানের উত্তর প্রান্ত। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারের ভিতর সোভিয়েত-ট্যাংকগুলো নড়ে উঠল একযোগে। রাশিয়ান বাহিনী আফগানিস্তানে হামলা করতে যাচ্ছে দানবীয় শক্তি নিয়ে। ঠিক এ সময়টিতে এ বইয়ের লেখক ছিলেন মায়ের কোলে-থাকা অবুঝ এক শিশু’—তখনই তিনি একটি চুম্বকের ভিতর আটকা পড়েন। পুরো বইয়ের সফর শেষে সর্বশেষ হরফটি উচ্চারণ করার আগ পর্যন্ত সেখান থেকে বের হওয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না।