ইংরেজরা ছিল মিথ্যার জাহাজ। মিথ্যা কথা বলা, মিথ্যা লেখা এবং মিথ্যা ভাষণে তাদের কোনো জুড়ি ছিল না। কীভাবে তারা মুসলমানদের হেয় এবং ছোটো করতে পারে—সেই চিন্তাতেই সর্বক্ষণ মশগুল থাকত। আর মুসলিম নেতা, মুসলিম বীর এবং মুসলিম শাসকদের তো ইংরেজরা কখনও সহ্যই করতে পারত না। এজন্য ইংরেজরা তাঁদের নামে, তাঁদের পরিবার এবং তাঁদের চরিত্রের ওপর মিথ্যা কলঙ্ক লাগিয়ে দিত। ইংরেজরা ঠিক তেমন করত ইতিহাসের ক্ষেত্রেও।
মুখের কথা তো আর বেশিদিন টিকে থাকে না। কিন্তু ইতিহাস? ইতিহাস তো বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী পর্যন্ত টিকে থাকে।
ইংরেজরা একদিকে ছিল যেমন শিক্ষিত, অপরদিকে ছিল তেমনই চালাক ও ধূর্ত। তারা জানত, কোনো মুসলমান সম্পর্কে কিংবা কোনো মুসলিম বীর বা নেতা সম্পর্কে যদি ইতিহাসে একবার খারাপ চরিত্রে, কুৎসিতভাবে তুলে ধরা যায়, তাহলে তা শতসহস্র বছর ধরে চালু থাকবে। হোক না তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। হোক না তা সম্পূর্ণ কাল্পনিক বা বানানো কথা। তবুও তা-ই পড়বে সবাই। পড়বে আর ভাববেÑহয়তো এটাই সঠিক ইতিহাস।
ইংরেজদের এই মিথ্যা ও ভুল ইতিহাস লেখার কারণ—এই যে বললাম, আমাদের পূর্বপুরুষদের ছোটো করে তুলে ধরা! যাতে করে উত্তরপ্রজন্ম তাদের পূর্বপুরুষকে ঘৃণা করে, তাদের প্রত্যাখ্যান করে।
তা-ই কি হয়? ষড়যন্ত্র আর মিথ্যা যত নিখুঁতই হোক না কেন, সত্যের একটা আলাদা ক্ষমতা আছে। বিশাল ক্ষমতা। সত্য তো সত্যই। সূর্যের মতো। কেউ তাকে রুখতে পারে না। সমুদ্রের বিশাল তরঙ্গের মতো। কেউ তাকে দাবিয়ে রাখতে পারে না। যা সত্য, তা একদিন না একদিন প্রকাশ হয়েই পড়ে। আর যখন প্রকৃত সত্য ভোরের সূর্যের মতো ভেসে ওঠে, তখন মিথ্যা আড়ালে চলে যায়। এভাবে একদিন আবারও লেখা হয় সত্য ইতিহাস। খসে পড়ে মিথ্যা ইতিহাসের নোংরা পাতা। বদলে যায় ইতিহাসের পুরোনো চেহারা।
ঠিক এমনটি হয়েছে সাইয়িদ নিসার আলীর ক্ষেত্রে। নিসার আলী আজীবন সংগ্রাম করেছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। ইংরেজ দুঃশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে।
নিসার আলীর সংগ্রামের কথা আমরা পরে জানব। তার আগে বংশপরিচয়টা জেনে নেওয়া যাক।
ইংরেজের বিরুদ্ধে সব সময় লড়ার কারণে নিসার আলীকে তারা আদৌ ভালো চোখে দেখত না। তারা চেষ্টা করত, কীভাবে বাংলার এই দুঃসাহসী বীরকে পরাস্ত করা যায়।
নিসার আলীকে ছোটো করার জন্য তাঁর সম্পর্কে ইংরেজরা অনেক মিথ্যা ও বানোয়াট কাহিনি লিখেছে। তাঁর পরিবার ও বংশপরিচয়েও রয়েছে সেই মিথ্যার ছলচাতুরী। এভাবে তারা নিসার আলীর জীবনেতিহাসকে কলঙ্কিত করতে চেয়েছে।
ইংরেজ ঐতিহাসিকরা লিখেছে—নিসার আলী একটি সামান্য কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যে পরিবারটি ছিল মূর্খ ও অশিক্ষিত। আসলে কিন্তু তা নয়। ইংরেজদের এই তথ্যাটি সম্পূর্ণ ভুল। ভুল ও মিথ্যা। মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
নিসার আলীকে আমাদের কাছে খাটো করে দেখানোর জন্য, চতুর ইংরেজরা এই মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো—নিসার আলী জন্মেছিলেন একটি বিখ্যাত ও নামকরা পরিবারে। বহুদূর পর্যন্ত ছিল সেই পরিবারটির সুনাম-সুখ্যাতি।
শুধু এক পুরুষ নয়। অনেক প্রজন্ম ও অনেক পুরুষ পূর্ব থেকেই পরিবারটি ছিল খুবই মর্যাদাসম্পন্ন। ধনসম্পদে, বিত্তবৈভবে, ধর্মীয় আচার-আচরণে, সম্মানে, মর্যাদায়, গৌরবে—মোটকথা, সকল দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ ছিলেন নিসার আলীর পূর্বপুরুষরা। শ্রেষ্ঠ ছিল তাঁর পরিবারটি।