অন্যের সঙ্গে নয়, নজরুল তুলনীয় কেবল নিজের সঙ্গে, যে নজরুল শিল্পাচারণে ও জীবনাচরণে বাংলা কবিতার আনুপূর্বিক ইতিহাসে এক অনন্য ও অদৃষ্টপূর্ব কূটাভাস। এই অনন্যতার মুখ্য সূত্রগুলাে হচ্ছে নজরুলের উপলব্ধির মৌলিকত্ব ও অভিনবত্ব, তার অভিব্যক্তির স্বতন্ত্র শৈল্পিক পরিশীলন এবং তার বাণীসত্যের মানবিক নান্দনিকতা। হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসে নজরুল এই বিষয়গুলাে যে-পথে ও যেভাবে রপ্ত, আত্মস্থ ও ব্যক্ত করেছেন, অন্য কোনাে বাঙালি কবির ক্ষেত্রে তেমনটি দেখা যায়
সচরাচর। এর উৎসে রয়েছে এক স্বয়ংক্রিয় শৈল্পিক সংশ্লেষ, যা স্বতঃস্ফূর্ততা ও সচেতনতার এক ঈপ্সিত ফসল। মানুষ হিসেবে নজরুলের বেড়ে ওঠার ইতিহাস আর কবি হিসেবে তার বেড়ে ওঠার। ইতিহাস যেমন সমান্তরাল, তেমনি অচ্ছেদ্য আলিঙ্গনেও অগ্রসরমান। খুব কম মুহূর্তই তার সচেতন জীবনযাপনে পরিদৃষ্ট, যা কম-ধর্ম বা সৃষ্টিমুখরতায় পরিব্যাপ্ত নয়। ব্যক্তি ও কবি। নজরুলের এই সার্বক্ষণিক সৃষ্টিশীলতাই তার। সনাক্তযােগ্য অনন্যতাও বটে। ফলে অনধিক আড়াই দশকের সৃষ্টিশীল জীবনে তিনি যে। বৈচিত্র্যময় উপলব্ধি, শৈলী-প্রকরণ, বাণীভঙ্গি ও মাঙ্গলিকতার শিল্পসম্মত টেক্সট তৈরি করেছেন, তা পরিমাণে ও তুল্যমূল্যে অভাবিতপূর্ব। নজরুলের চেয়ে অনেক বেশি কাব্যফসল ফলিয়েছেন তার অজস্র অগ্রজ ও অনুজ কবি-কারুকৃৎ, কিন্তু শৈল্পিক ও মাঙ্গলিক অভীষ্ট সাধন করে প্রতিটি সৃষ্ট-ভাষ্যকে স্বতন্ত্র মর্যাদায় উন্নীত করার ক্ষেত্রে তার জুড়ি মেলা ভার।
মুহম্মদ নূরুল হুদা
সমকালীন বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কণ্ঠস্বর মুহম্মদ নুরুল হুদা। তাঁর কাব্যপ্রয়াসের কেন্দ্রে রয়েছে ব্যক্তিমানুষ, জাতিমানুষ ও বিশ্বমানুষের সমীকৃত প্রতিকৃতি জাতিসত্তার কবিরূপে বহুল নন্দিত। তাঁর সৃষ্টিসত্তা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা, প্রকরণ ও উদ্ভাসে নিয়ত নবায়নপ্রবণ। স্বােপার্জিত কাব্যমুদ্রা ও নন্দনলােকের বরপুত্র এই বাঙালি কবি সমকালীন বিশ্বকবিতারও এক তাৎপর্যপূর্ণ কারুকৃৎ। মুহম্মদ নূরুল হুদা ১৯৪৯ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর কক্সবাজার জেলার জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মােহাম্মদ সেকান্দর ও মাতা আমান আরা বেগম। মূলত কবি তিনি। তবে কথাসাহিত্য, মননশীল প্রবন্ধ ও অনুবাদসহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তিনি বিচরণশীল। অতিপ্ৰজ ও সব্যসাচী এই লেখকের স্বরচিত, অনূদিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা শতাধিক। তার প্রিয় ক্ষেত্রে কবিতা, নন্দনতত্ত্ব ও লােকবিদ্যা। সৃষ্টিশীলতার নানা ক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য অবদানের জন্য তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্মানিত ও পুরস্কৃত। তিনি বাংলা একাডেমির ফেলল, আমেরিকান ফোকলাের সােসাইটি, ইন্টারন্যাশনাল সােসাইটি ফর ফোক ন্যারেটিভ রিসার্চসহ বহু আন্তর্জাতিক সংস্থার সম্মানিত সদস্য। তার কবিতাবলির পাশাপাশি বহু প্রবন্ধ নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে। মুহম্মদ নুরুল হুদার প্রাপ্ত পুরস্কারগুলাে মধ্যে উল্লেখযােগ্য- আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৮), একুশে পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।