বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস রচনায় এই গ্রন্থ নিঃসন্দেহে মূল্যবান সংযোজন। লেখক মঈদুল হাসান একাত্তর সালের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পটভূমিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, সামরিক ও কূটনৈতিক সকল মূল উপাদানকেই একত্রে তুলে ধরেছেন। এই সব উপাদানের সংঘাত ও সংমিশ্রণে কিভাবে সফল রণনীতির উদ্ভব ঘটেছিল সেই ইতিবৃত্ত এই বিবরণে রয়েছে। এগুলিকে তিনি হাজির করেছেন ঘটনাবিকাশের নিজস্ব ধারাবাহিকতায়, যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষ সাক্ষ্য-প্রমাণসহ। এ ছাড়া অনেক ঘটনা ও অনেক গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের কথা তিনি প্রকাশ করেছেন, যেগুলির অনেক কিছুই আজও অপ্রকাশিত, অথচ যেগুলি ছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির কোন সঙ্গত ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। এ জাতীয় বিবরণ সম্ভবত কেবল এই লেখকের পক্ষেই সম্ভব ছিল। কারণ প্রবাসে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এবং তাঁর পক্ষ থেকে ভারত সরকারের উচ্চতর নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ব্যাপারে লেখক ছিলেন বিশেষ আস্থাভাজন ব্যক্তি। তাঁদের দু’জনার মাঝে যোগাযোগ ছিল ঘনিষ্ঠ ও নিয়মিত। মুক্তিযুদ্ধকালের অনেক ঘটনার জন্যই লেখক এক নির্ভরযোগ্য সূত্র। একাত্তর সালে পাকিস্তানী বাহিনীর হত্যা, বর্বরতা ও সন্ত্রাসের ফলে ভারতে আশ্রয়প্রার্থী মানুষের সংখ্যা অকল্পনীয়ভাবে বেড়ে চলে। প্রথমদিকে প্রবাসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে পরিস্থিতি ছিল বহুলাংশেই অসংগঠিত ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। সেই সময় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে কর্মরত থাকার ফলে আমি এই বিশৃঙ্খল ও অনিশ্চিত অবস্থা থেকে এই জাতির স্বাধীনতায় উত্তরণের জটিল প্রক্রিয়ায় কোন কোন দিক লক্ষ্য করার সুযোগ পেয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি,আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন সকল ঘটনার কেন্দ্রে এবং অপরিসীম নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করে গেছেন। কিন্তু তাঁর নিজের ভূমিকা সম্পর্কে এই মিতভাষী মানুষটি প্রায় কিছুই বলে যাননি। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের অনেক খানিই আজও অনালোকিত। তার কোন কোন অংশে আলোকপাত করার ব্যাপারে মূলধারা:’৭১ সমর্থ হয়েছে বলে আমার ধারণা। তবে মঈদুল হাসান, সঙ্গত কারণেই সমগ্র বিষয়কে বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে উপস্থিত করেছেন পর্যাপ্ত গবেষণা ও অপ্রকাশিত নানা দলিলপত্রের ভিত্তিতে ঘটনার নিরপেক্ষ উপস্থাপনের উদ্দেশ্যেই।
মঈদুল হাসান
মূলধারা ’৭১ গ্রন্থের লেখক ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মঈদুল হাসানের জন্মদিন আজ। তিনি বাংলা ১৩৪৩ সনের ১৪ শ্রাবণ বগুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তার শৈশব কাটে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সীমিত আর্থিক সচ্ছ্বলতার মাঝে, স্নেহ ভালোবাসা, সুখ দুঃখের পরিবেশে, ভালো ও মন্দের ব্যবধান শিখে এবং জ্ঞান অন্বেষণের অঙ্গুরিত প্রবণতা নিয়ে। তখন বিশ্বমণ্ডলে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বে। তিনি যুদ্ধ, ক্ষুধার্ত মানুষের আর্তনাদ, পরাধীনতা গ্লানি, সাম্প্রদায়িকতার দাঙ্গা, আজাদী পাকিস্তান ও বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষ সাক্ষী হয়ে আছেন।
পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ( ১৯৫৬-৬০)। শেষ বর্ষের ছাত্র অবস্থায় তিনি সেই সময়ের বহু প্রচারিত দৈনিক ইত্তেফাক এ সম্পাদকীয় লেখা শুরু করেন। এতে করে তিনি পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গতিধারা পর্যবেক্ষণ করেন গভীরভাবে।
একসময়ে তিনি সাংবাদিকতা ছেড়ে দেন। ছয় বছর পর তিনি ১৯৭১ সালে প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পালন করেন অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে ভারতের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারক সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছিল তাঁর অন্যতম দায়িত্ব।