মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি (ছোটদের জন্য লেখা প্রথম উপন্যাস ১৯৭৮)
মনোজদের বাড়ীটা একটা ভারী আজব জায়গা। সেখানে এমন অদ্ভুতুড়ে কান্ড নেই যা হয়না। ওদের বাড়ীতে আছে ওর ঠাকুমা, ওর বাবার এক বুড়ো পিসি, মা, বাবা, দুই কাকা, দিদি, দাদা, আর দুটো ছোট ছোট ভাই বোন। কাজের লোকদের মধ্যে আছে রঘু, রান্নার ঠাকুর, নিরাশ্রয় এক বুড়ো রামু আর বুড়ি ঝি কিড়মিরিয়া। আরো বিস্তর লোকজনের আসা যাওয়া ওদের বাড়ীতে। যেমন পুরুতমশাই সতীশ ভরদ্বাজ, মাস্টারমশাই দুঃখহরণবাবু, গানের মাস্টারমশাই গণেশ ঘোষাল সহ আরো কত কে! মনোজের বাবা রাখোহরিবাবু ভারী রাগী লোক। বাড়ীর লোকজন তো বটেই, বাড়ীর কুকুরটা বেড়ালটা পর্যন্ত তাকে ভয় খায়। কিন্তু তিনি ভয় পান শুধুমাত্র বাড়ির একজন ব্যক্তিকে। সে হলো তার পিসিমা আদ্যাশক্তি দেব্যা। মনোজরা তাকে ‘ঠাকুরঝি’ বলে ডাকে। তার খুব আছাড় খাওয়ার অভ্যাস, ওই করে করেই তার একটা পা খোঁড়া। মনোজের ঠাকুমা বামাসুন্দরী দেবী ডাল ফেটাতে খুব ভালোবাসেন। তিনি ডালের বড়ি রোদে দিয়ে রাখেন কিন্তু আদ্যাশক্তির ভয়ে কোন কাক পক্ষীও সেই ডাল ছড়ানো ছেটানোর সাহস পায়না। কারণ, তিনি একটা গুলতি হাতে নিয়ে খোঁড়া পায়েই সারা বাড়ী ডিং মেরে বেড়ান। মনোজের দুই কাকা ভজহরি আর হারাধন। হারাধন বৈজ্ঞানিক আর ভজহরি বিখ্যাত বাজারু। বাজার করা তার কাছে একটা আর্ট। অসাধারণ তার বাজার করার ক্ষমতা। সব দোকানী তার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। মাস্টারমশাই দুঃখহরণবাবু উবু হয়ে না বসলে পড়াতে পারেন না। আর গানের মাস্টারমশাই গণেশ ঘোষাল তালে লয়ে ভুল হলেই গলায় দড়ি দিতে যান। মাসের মধ্যে দু-তিনবার তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। বাড়ীর চাকর রামু চোখে কম দেখে। মাঝে মাঝে সে লংকা বলে কাড়াইশুঁটি, মুলো মনে করে গাজর আর ঘনেপাতার বদলে গুচ্ছের ঘাস তুলে নিয়ে যায়। অদ্ভুত লোকজনে ভরপুর মনোজদের বাড়িতে এত এত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে প্রতিদিন যে এসব ওদের সয়ে গেছে। কিন্তু একদিন আরো বেশী অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে লাগলো মনোজদের বাড়িটায়। সব ঘটনার মূলে আছে একটা ছবি। একটা বাচ্চা ছেলের ছবি। বাড়ীর কেউ জানেনা সেটা কার ছবি। মনোজ তাই অ্যালবাম থেকে আলাদা করে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল ছবিটা। জানা গেল, ছবিখানা ছোটবেলায় হারিয়ে যাওয়া হরিণগড়ের রাজকুমার কন্দর্পনারায়নের। কন্দর্পনারায়নকে কেউ চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল তার সব ছবি। যাতে তাকে খুঁজে বের করার কোন চেষ্টা করা সম্ভব না হয়। রাজকুমারের ছবি খোঁজার জন্য গোয়েন্দা বরদাচরণকে নিযুক্ত করেছেন রাজামশাই। তাছাড়া যার কাছে ছবি পাওয়া যাবে তাকে দেয়া হবে নগদ এক হাজার টাকা পুরষ্কার! একদিন রাজবাড়ীতে এল ডাকাত। ডাকাতদলের মেজ সর্দার এক তরুণ। নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে জানা গেল সেই মেজ সর্দারই হারিয়ে যাওয়া রাজকুমার কন্দর্পনারায়ণ। আর তাকে রাজকুমার হিসেবে যে প্রথম চিনতে পেরেছিল সে হলো মনোজ নিজে! যে এতদিন যত্ন করে আগলে রেখেছিল রাজকুমারের ছবিখানা! পাঠ অনুভূতিঃ ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ী’ বইটার পাতায় পাতায় শুধু হাসি আর হাসি। খুব কম গল্পের বই আছে যেগুলো পড়ে এত হাসতে হয়! খুব মজা করে পড়ার মতো বই। এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। শেষ না করে উঠতে মন চায়না। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বড়দের জন্য যেমন ভালো লেখেন, বাচ্চাদের জন্যও তেমনি ভালো লেখেন। একজন লেখকের জন্য ছোট-বড় দুই ধরণের বয়সীদের জন্যই সমানভাবে ভালো লেখাটা একটু কঠিন কাজ। কারণ, বড়দের জন্য একভাবে ভাবতে হয় আবার ছোটদের জন্য অন্যভাবে ভাবতে হয়। বাচ্চাদের জন্য বাচ্চাদের মতো করে ভাবতে হয়। এই দুই ক্ষেত্রেই যেহেতু তার লেখার হাত সমান চলে তাই তাকে একজন সব্যসাচী লেখক বলা যায়। #বইবাজার_রিভিউ_প্রতিযোগীতা_মার্চ_২০১৯