একটা কথা প্রচলিত আছে, যুদ্ধে পেছন ফিরে তাকাতে নেই। সহযোদ্ধা বুলেটবিদ্ধ হয়ে পড়ে গেছে, কিন্তু দ্রোহের আর মুক্তির চেতনা সেই বিষাদকে পায়ে দলে আরও একবার বারবারের মতোই শত্রুর মুখোমুখি হতে চায়। ভোরের অপেক্ষায় একটা বেঘোর অন্ধকার রাত পার করে। ছাপাখানার ভূত'-এর গুটিকয়েক কাজ যেন সেই উপলব্ধি বয়ে এনেছে প্রায়োগিক রূপে। যার হাত ধরে এই মহীনের ঘোড়াগুলির গান-এর পরিভ্রমণ শুরু করেছিলাম, তিনি নেই। তিনি রঞ্জন ঘোষাল। রঞ্জনদা প্রথম দিনের কথায় বলেছিলেন, 'কোনো এক শীতে একটা ট্রেন ধরে তোমাদের শহরে চলে যাব।' আয়োজন চলছিল তারই, কিন্তু তার আগেই তিনি একটা অনন্তের রাস্তার রেলগাড়ি করে কোথায় চলে গেলেন... তার বহু আগেই চলে গেছেন দিকপাল ঘোড়া গৌতম চট্টোপাধ্যায়, সকলের মণিদা। কিন্তু মণিদা নেই, তা আর মনে নেই। আমি এখন প্রায়ই মণিদাকে দেখি। তার সাথে আলাপ হয় মাঝে-মধ্যেই। ২০১৮ সালের শীতে রঞ্জনদার সাথে কথা হয়েছিল। কথা হয়ে যাওয়ার পর প্রস্তুতিপর্বে চলে গেছে প্রায় ছয় মাস। রঞ্জনদাকে আবার কল করতেই বললেন, কী যেন কথা হয়েছিল?' অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে আমাদের পরিকল্পনার কথা রঞ্জনদার মাথা থেকে ছুটে গেছিল। তারপর আবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি। পরীক্ষা দেওয়া। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। অত:পর এল ২০ জানুয়ারি, ২০১৯ সাল। আরেক শীত। শীতের সন্ধ্যা। এরপর থেকে আমার খোঁজ। খুঁজতে গিয়ে আরও খোঁজ। খোঁজ পেয়ে আরও খোঁজ। এই করে করে আরও ২ বছর। অর্থাৎ ৩ বছর এর মধ্যে গত... শেষের ১ বছরে আসলে আমরা প্রত্যেকে একে অপরের সাথে একাত্ম হতে শুরু করলাম। আমার একাগ্রতা দেখে সকল ঘোড়ারা যখন যা চেয়েছি, সেই মতো সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে আমাকে ধন্য করেছে। অনেক কাটাছেঁড়া। অনেক আলোচনা, না এটা না ওটা। ওটা না, এটা। যুক্তি-তর্ক। অবশেষে সিদ্ধান্ত হল, এবার বেরিয়ে পড়ার পালা। অর্থাৎ 'মহীনের ঘোড়াগুলি' দৌড় শুরু করল ছাপাখানার পথে। এই মহাগ্রন্থে আমার সাথে কজন ঘোড়া কলমও চালিয়েছেন। তাঁরা হচ্ছেন রঞ্জন ঘোষাল, তাপস দাস (বাপীদা), বিশু চট্টোপাধ্যায় ও সঙ্গীতা ঘোষাল (রিঙ্কুদি)। একাত্ম হল আস্তাবল থেকে বেরিয়ে পড়ার আগে তপেশ বন্দ্যোপাধ্যায় অর্থাৎ ভানুদা, দৈবাৎ মহীনের গান শুনে সবিস্ময়ে ছুটতে ছুটতে মহীনের আদিঘোড়া বিশু চট্টোপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় ঘোড়াদের আস্তাবলে জায়গা করে নেয়া রাজা ব্যানার্জির গল্প। আরেক পাখির মতন ঘোড়া, যে কিনা এই সুরে বহুদূরে গাইতে গাইতে মণিদা, রঞ্জনদার মত অনন্তের রেলগাড়িটা ধরে ফেলেছিল... নানান বিরল তথ্য আর ঘটনা দিয়ে একাত্ম হয়েছেন মিনতি চট্টোপাধ্যায় (গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী), শর্মিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায় (প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী), রিঙ্কুদি ও মধুশ্রী মজুমদার (এব্রাহাম মজুমদারের স্ত্রী)। এবারে সমবেত এই প্রচেষ্টার চেহারাটা ঠিক কী রকম? কী রকম হল দেখতে ওকে? সমস্তটা পাঠক বিচার করবেন। শুধু শেষ করতে চাই বুলাদা অর্থাৎ প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়ের একটি ছোট্ট কথা দিয়ে। এই যুদ্ধ চলাকালীন নানান কথার ভিড়ে তিনি বলেছিলেন সহাস্যে, তুমিও ত আমাদেরই মতন এক ঘোড়া। যেন তুমি তখন আমাদের সঙ্গেই ছিলে।' আর কিছু না, কথাটা কানে বাজে। প্রাণে বাজে। শক্তি দ্যায়। আরেকটা কথা বলে নেয়া ভালো, এখানে আদিঘোড়াদের আঙুলের স্পর্শে প্রাণ পাওয়া মহীনের ঘোড়াগুলি'র প্রকাশিত সকল গান ত বটেই, সঙ্গে থাকছে অপ্রকাশিত বেশ কিছু গানের সম্পূর্ণ লিরিক সমেত কর্ড। এবং এব্রাহাম মজুমদারের করা ৩টি গানের স্টাফ নোটেশন।