লালসালু মূলত একটি সামাজিক উপন্যাস। যুগ-যুগ ধরে প্রচলিত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ও ধর্মীয় ভীতি এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। মজিদ নামে এক স্বার্থান্বেষী, ভণ্ড ধর্মব্যবসায়ীকে কেন্দ্র করে এর কাহিনী গড়ে উঠেছে। স্বার্থান্বেষণে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে অবশেষে সে মহব্বতনগর গ্রামে ঘাঁটি গাড়ে মাতব্বর খালেক ব্যাপারীর বাড়িতে। সেই গ্রামের বাঁশঝাড়সংলগ্ন ছিল একটি পরিচয়বিহীন কবর। এরপর মজিদ প্রচার করতে শুরু করে কবরটি ‘মোদাচ্ছের’ (নাম না জানা) পীরের এবং স্বপ্নাদেশে মাজারের তদারকির জন্যই এ গ্রামে তার আগমন ঘটেছে। গ্রামবাসী তার স্বপ্নের বিবরণ শুনে ভীত হয় এবং একইসাথে বিশ্বাস করে। তারা কবরটি দ্রুত পরিষ্কার করে লালসালুতে ঢেকে সেটিকে একটি পীরের মাজারে পরিণত করে। আর মজিদ হয়ে উঠে মাজেরের খাদেম। এভাবে মজিদের একচ্ছত্র আধিপত্যের প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠে মাজারটি। অল্পদিনের মধ্যেই মজিদ সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠে। ধর্মকর্মের মধ্য দিয়ে নিজেকে অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলে প্রচারের মাধ্যমে গ্রামের প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিতে পরিণত হন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বহুপঠিত ও প্রশংসিত উপন্যাস লালসালু লেখা হয়েছিল বিশ শতকের চল্লিশের দশকে। মিতপরিসর এই গ্রন্থটি নিয়ে উপন্যাসরসঞ্জ বিদ্বজ্জনেরা নানা কৌণিক দিক থেকে অনেক আলোচনা করেছেন এবং এখনো করে চলেছেন। এ ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের সমালোচকেরাও পিছিয়ে নেই। বস্তুত পূর্ব বাংলায় রচিত আর কোনো উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের সমালোচকদের এতখনি মনোযোগ আকর্ষণ করেনি। এর কারণ আছে। পূর্ব বাংলার এক মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামে একজন অচেনা- অনিকেত ব্যক্তি কেবল ধর্মকে আশ্রয় করে অজ্ঞ অধিবাসীদের ওপর ক্রমান্বয়ে কীভাবে সীমাহীন প্রভাব বিস্তার করে তাদের শোষণের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে তারই খণ্ড খণ্ড চিত্র উপন্যাসটির মুখ্য বিষয়। এই প্রভাব-প্রতিষ্ঠার মূলে আছে গ্রামবাসীদের মনে সুকৌশলে এক অজানা ভীতির সৃষ্টি। উপন্যাসের শেষ দিকে কিশোরী একটি মেয়ের অনুপ্রবেশ সেই ভয়ের দরজায় প্রথম পদাঘাত করেছে। অসামান্য শিল্পকুশলতায় ঔপন্যাসিক টুকরো টুকরো কিছু ঘটনাকে একসঙ্গে গ্রপ্তি করে একটা বিশেষ অঞ্চলের সমাজকে তার আস্ত চালচিত্রসহ বিশ্বস্ততার সঙ্গে জীবন্ত করে তুলছেন। এই সমাজচিত্রের অন্তর্মুলে কেবল ধর্ম নেই, আছে সমাজবিজ্ঞানের সূক্ষ্ম-গভীর অনিবার্য ফল- পরিণতি। যথার্থ শিল্প হয়ে ওঠা এই সমাজচিত্র তাই বিশেষ কোনো দেশের বিশেষ কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের জীবনচিত্র হয়ে থাকেনি, ধর্মকাতর কিন্তু অজ্ঞ-মূর্খ যে-কোনো মানব সম্প্রদায়ের কাহিনি হয়ে গেছে। বিশেষ যখন নির্বিশেষ হয়ে ওঠে, তখনই সৃষ্টি হয় যথার্থ সাহিত্য। সেজন্যই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত এই উপন্যাস সেই সেই ভাষাভাষীদের কাছে সমাদৃত হতে পেরেছে। সমাজ ও সমাজমন দুদিক থেকেই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি ও গভীর অন্তর্দৃষ্টির ফসল লালসালু। এতে যে দেশ-কাল- সমাজ বিধৃত হয়ে আছে, তারপর অতিক্রান্ত হয়েছে অন্তত পৌনে একশ বছর। পূর্ব বাংলা রূপান্তরিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। তারও বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের চারিত্রলালিত কোনো পাঠকের মনে যদি এই জিজ্ঞাসা জাগে যে দীর্ঘ এতগুলো বছর পর মহব্বতনগর তথা পূর্ব বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের উত্তরপুরুষেরা সময়ের গতির সঙ্গে জগৎ ও জীবনদৃষ্টিতে কতটুকু এগিয়েছে, তাহলে সে-জিজ্ঞাসাকে কোনোভাবেই নিরর্থক বলা যাবে না। বরং সেই জিজ্ঞাসার উত্তর লালসালু পুনঃপাঠের ভেতর দিয়ে অন্বেষণ করা খুবই জরুরি।