নিজেকে বিক্রি করতে পারা কিংবা বিক্রি করার চেষ্টা করা অথবা নিজের বিরুদ্ধে নিজেকে দাঁড় করিয়ে বিশ্লেষণ করা এই সময়ের মুখচ্ছবি। সেখানে বাস্তব কিংবা কাল্পনিক চরিত্ররা একেকটি বিস্ময়! অন্ধকার ফুটপাত থেকে উঁচু মুখের থাবায় চলে যায় অন্ধ রেলগাড়ি। আর অতিরিক্ত ঘ্রাণে জড়িয়ে
যায় মুদি থেকে গোরস্তান। মৃত্যুস্রোত ও গহীনের আলো আনন্দকে ডুবিয়ে দেয় চেহারার ঘনত্ব। তারপরও রক্তভ্রম, আহত কি-বোর্ড, শীতবইয়ের শর্তসমূহ ঘেউমারা পড়শি চোখের যাদুতে জেগে থাকে দীর্ঘপথ। পাশাপাশি হাঁটতে থাকা ছায়াগুলো কানে-মুখে ঢুকে যায়। আবার বেরিয়েও যায় উচ্চতায়, নিজস্বতায় অথবা নানা পরিচ্ছেদে। গল্পের বয়ানে উহ্য আছে এমন অনেক গোপন সাঁকো। পথ জুড়ে শর্তের ভেতরের চোখকে আবিষ্কার করার চেষ্টায় চারপাশে তৈরি হয়েছে খণ্ড খণ্ড দৌড়। ‘লাবণ্য দাশের সাথে দেখা হওয়ার পর’ গল্পগ্রন্থটি এমনই দশটি গল্প কিংবা দশটি পরিচ্ছেদে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রথম ছায়া আমার দিকে গভীর করে তাকায়। তার চোখে যেন কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা। কী খুঁজছে সে? আমি নিজের পুরো শরীরটা একবার ঘুরে আসলাম। ধাস্তাধস্তি করার কারণে আমার পুরো শরীরটাই ক্ষত-বিক্ষত। আর পশুত্বের চিহ্ন রাখতে এরাও কম করেনি। ইচ্ছে মতো অত্যাচার করেছে। আমি বোবা রোবটের মতো সয়ে গেছি। বাধ্য হয়েছি। মুখ, হাত-
বাঁধা একটা মানুষ আর কী করতে পারে! বাম পাশটা ফেটে পুরো কপালটায় রক্তে মাখামাখি হয়ে লেপ্টে আছে। নিচের ঠোঁটের ডান পাশটা ফেটে রক্ত গড়িয়ে জমাট হয়ে আছে। গলার নিচে বেসামাল কামড়ে ছিলে গেছে অনেকটা। বাম স্তনের নিচে নখের আঁচড়ে এমন হয়েছে যে, শকুনের খুবলে খাওয়া মড়ক মনে হচ্ছে নিজেকে। নাভীর নিচের দিকটার অবস্থা আরও খারাপ। পিংক কালারের পাজামাটার অধিকাংশই ছেঁড়া। পাজামাটা ওরা কোনো রকম পেচিয়ে রেখেছে ঠিক। কিন্তু ফিতাটা বেঁধে রাখার প্রয়োজন মনে করেনি। কেনই বা করবে! কী আর প্রয়োজন আছে সংরক্ষণের! ঢেকে রাখার! বুকের মতো উন্মুক্ত হলেও আমার শরীর এখন আর কাউকে কামোদ্দীপক করে তুলতে পারবে না। যোনির চারপাশ ক্ষত আর রক্তে মাখামাখি। নাহ্ আমার কাছে কিছুই নেই এখন! যার দিকে কেউ ওমন ভঙ্গিতে তাকাতে পারে। আমি সন্দেহের মধ্যে পরে গেলাম। বাকি দুজন আদর্শ শ্রমিকের মতো মাটি খুঁড়ে যাচ্ছে। তাদের কাছে এই মুহূর্তে এর চেয়ে কোনো জরুরি কাজ নেই। সত্যিই তো নেই। তারা এ ছাড়া আর কী করবে! আমি নিজেকেই প্রশ্ন করি। আমি হলে কী করতাম? নাহ্ আমি কোনো যুক্তি দাঁড় করাতে পারছি না। ইস্ আমি যদি হাতটা একটু নাড়াতে পারতাম! ছুঁয়ে দেখতে পারতাম আমার যত্নে রাখা শরীর। শরীরের প্রিয়সব স্থান। রাফির ভালোবাসা...
[ ‘চাঁদের মুখোমুখি রাত ‘ গল্প থেকে ]
আমি আর সীমান্ত বাসন্ডা নদীর পাড় ধরে হাঁটছিলাম। আজও লাবণ্যকে স্বপ্ন দেখার কথা বললাম। আজ আর সীমান্ত হাসলো না। ওকে কেমন চিন্তিত মনে হলো।
‘জানিস গত রাতে আমি তসলিমাকে স্বপ্ন দেখেছি।’
আমি জোরে হাসলাম। এ হাসি শরীয়তের তিন প্রকার হাসির আওতায় আটকে থাকলো না। আমার হাসি দেখে সীমান্ত কিছুটা বিরক্ত হলো।
‘আচ্ছা তুই প্রতিরাতে জীবনানন্দের বউকে স্বপ্নে দেখতে পারিস। আর আমি সিঙ্গেল তসলিমাকে স্বপ্ন দেখতে পারবো না?’
.......
শহরের বইপত্র লাইব্রেরী থেকে তসলিমার বই কেনার সময় আমি ওর মুখে দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আহারে বেচারা। কেমন খুশি খুশি মন! কিন্তু এই খুশিখুশি মুখটা মুহূর্তেই চিন্তিত মনে হয়। কারণটাও আমার অনুমেয়। যে কোনো শরীয়া বিরোধী বিতর্কিত বই আমাদের ছাত্রাবাসে রাখা নিষেধ। পাঠ তো দূরের কথা।তারপরও নসীম হিযাযীর সাথে সাথে আমি আর সীমান্ত হুমায়ুন আযাদ-তসলিমা নাসরিন পড়ি। এই পড়া প্রজেক্টকে বাস্তবায়ন করতে আমাদের রীতিমত এক যুদ্ধ জয়ের কৌশল অবলম্বন করতে হয়। একরুমে আমরা ছয়জন থাকি। বড় রুম। ছোট ছোট ছয়টা চৌকি। চৌকির সাথে ছোট একটা করে টেবিলও। টেবিলে ক্লাসের বই সাজানো থাকে। বাকী জিনিসপত্র চৌকির নীচে তোরঙ্গতে রাখতে হয়। আমাদের অন্য চারজন রুমমেইটের একজন আবার কুরআনে হাফেজ। যে কারণে এশার নামাজ ফাঁকি দিয়ে রুমে তালাবদ্ধ হয়ে বসে থেকে টেবিল লাইট জ্বালিয়ে বই পড়ার কৌশলও সবসময় নিরাপদ হয় না। তার থেকে ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অসুস্থতার অজুহাতে রুমে তালাবদ্ধ থেকে নিষিদ্ধ বই পড়ার কৌশলই ভালো কাজ দেয়। কারণ নামাজে যাওয়ার সময় একবার এবং নামাজ চলাকালীন সময়ও মাঝে মাঝে রুম চেক করা হয়। যাতে কেউ ফাঁকি দেয়ার সুযোগ না পায়। তবে সুবিধার বিষয় হলো হাফেজ সাহেব অল্প বয়সে বিয়ে করার কারণে অধিকাংশ সময়ই বাড়িতে থাকে। তার বাড়ি থাকার সুবাধে আমরা তসলিমা ধরনের বিভিন্ন বই এশার নামাজের সময় ও ক্লাস ফাঁকি দেয়ার সময় পড়তে পারি।
সানাউল্লাহ সাগর
Title :
লাবণ্য দাশের সাথে দেখা হওয়ার পর (হার্ডকভার)