১৯৭১ ১. ‘যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভুলে না মোরে।\' নীল খাম। নীল চিঠি। উড়াল পাখি। থমকায় পাখি মেঘÑমাখো মাখো আকাশে। ফিরে আসে। বুকজুড়ে রক্তের লাল। কেউ কি কাউকে ভোলে? ২. গাছের ছায়ায় বসা। দীর্ঘ পথ-পাড়ির ক্লান্তি। পাহাড় ডিঙিয়ে এখানে আসা।দূরের আকাশ ছেয়ে আছে ধুঁয়ায়। জয় বাংলার গ্রাম জ্বলে যাচ্ছে।এই পাহাড় ডিঙিয়ে আবার ফিরে যাওয়া হবে। হাতে শুধু একটা থ্রিনটথ্রি চাই। ৩. বন্ধুর ব্যাগে লাল মলাটের বই। এটাই নাকি তার যুদ্ধের প্রেরণা। বিপ্লবের স্বপ্ন। হায় বন্ধু! কারাবন্দী! তার কাটা মুণ্ডু গড়াগড়ি খায় পাহাড়ি জঙ্গলে। দূর-আকাশে মেঘের সাথে ধুঁয়ার জটলা। শরাহত পাখি ফিরে ফিরে আসছে। প্রান্তরজুড়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত। ধার করে পাওয়া থ্রিনটথ্রি নিজের দিকেই তাক করা। ট্রিগারে নিজেরই হাত। ১৯৭৪ ১. ‘ফ্যান দেবে গো, একটু নুন!’ পুরবাসী দুয়োর এঁটে চুপ। ২. খলখল জলধারা। ঢেউয়ের পর ঢেউ। ভাঙে পাড়। ডোবে শস্যক্ষেত। বালুচরে পড়ে থাকে মানুষ। জমিনে নিস্পন্দ মানব-জীবন। পাশেই দু’তিনটে পেটমোটা কুকুর আয়েশে গড়াগড়ি যায়। আরো দু’তিনটে খুবলে খায় মানবদেহের পবিত্রতা। নির্মম আকাশ। এক ফোঁটা মেঘ নেই। ভোজন-ক্লান্ত বিলাসী শকুন দল উড়তে ক্লান্তি বোধ করে। ৩. জ্বলে যায় উদর। এক মুঠো ভাতের জন্য সতীত্বের ছিন্ন পাটি বিছিয়ে দেয় ধুলোয়। রক্তাক্ত মাংসের না-চাওয়া পিণ্ড ধারণ করে উদর। আলোকিত শহরে প্রকাশ্য দিবালোকে মুখ থুবড়ে পড়ে উলঙ্গ মানুষ। বোধহীন। স্পন্দনহীন। ৪. ক্ষুধার্ত হাত কি শুধুই অন্ন খোঁজে? রাতে নামে ক্ষুধার্ত মিছিল। জ্বলে যায় শহর। মাটিতে লুটোয় পেটমোটা রিলিফ চেয়ারম্যান। অনন্ত শব্দমালা রচিত হয়: ট্যারেট্যাটাটাটা। ১৯৭৫ ১. বন্দুক লড়াই করে বন্দুকের সাথে। রক্তখেকোর মুখ রক্তখেকোর মুখোমুখি। আকাশে শকুনেরা গান গায়। ২. উর্দিধারী একজন আরেকজনকে বলে: আয়, আমরা নিজ নিজ বন্দুক পাহারা দিই। ৩. কার্ফ্যু শহর। কার্ফ্যু দেশ। ভক্ত কুকুরদল রাজপথে সামগীতি গায়। ১৯৮০ একান্তভাবে ব্যস্ত নিজেকে নিয়েই। রিংঝোলা বানরের মতো মাঝ-সিঁড়িতে তড়পানো। চাঁদ কি হাতের নাগালেই? ও চাঁদ! ছিটেফোঁটা-ছিটেফোঁটা তোর আলো ছোঁয়ার জন্য লাফালাফিÑলাফালাফি। চাঁদপনা-মুখো বধূকুল ঘুমপাড়ানি গেয়ে গেয়ে সাহস জোগায়। মাঝের সিঁড়ি স্কাইস্ক্রেপার বিল্ডিংয়ের লিফটের মতো নেমে যাচ্ছে। চারপাশের বেষ্টন নিবিড় হয়ে আসছে বুক বরাবর। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। বেঁচে থাকা বড় কষ্ট। ডাকছে অতল। নেমে যাওয়া নেমেই যাওয়াÑ। ১৯৮১ এবং হাতেই আছেন তিনি। মুহুর্মুহু পতনেও তিনি হাতেই। তিনিই অবলম্বন। অনন্ত শব্দমালা, জেগে ওঠো। ঐ উঁচুতেই তো শকুনদের ওড়াউড়ি। তিনিই একদিন শব্দমালা গাঁথবেন: ট্যারেট্যাটাটাটা
আতা সরকার
কথাসাহিত্যিক আতা সরকার ১৭ই জুন, ১৯৫২ সালে জামালপুর শহরে জন্মগ্রহণ করেন। কৈশোরে আইয়ুবী কালাকানুনে তাঁর সম্পাদিত ম্যাগাজিন এবং সত্তরের দশকের শেষে তাঁর গল্প প্রকাশের অভিযোগে লিটল ম্যাগাজিন বাজেয়াপ্ত হয়। রাজনৈতিক সচেতনতা-সমৃদ্ধ তাঁর গল্প। সমাজ-অসঙ্গতি, রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা ও সমাজপতিদের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তিনি উচ্চকণ্ঠ। আর একই সাথে তিনি বীজ বোনেন এক নতুন স্বপ্ন-বিশ্বের।