“কয়েকটি মৃত্যু”বইটির প্রথম দিকের কিছু কথাঃ
গলিটা অনেকদূর সরলরেখার মতাে এসে হঠাৎ যেখানে মােড় নিয়েছে, ঠিক সেখানে আহমদ আলী শেখের বসতবাড়ি।
বাড়িটা এককালে কোনাে এক বিত্তবান হিন্দুর সম্পত্তি ছিলাে। দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের চব্বিশ পরগণার ভিটেবাড়ি, জমিজমা, পুকুর সবকিছুর বিনিময়ে এ দালানটার মালিকানা পেয়েছেন। মূল্যায়নের দিক থেকে হয়তাে এতে তার বেশকিছু লােকসান হয়েছে, তবু অজানা দেশে এসে মাথাগোঁজার একটা ঠাই পাওয়া গেলাে সে-কথা ভেবে আল্লাহর দরগায় হাজার শােকর জানিয়েছেন আহমদ আলী শেখ।
সেটা ছিলাে উনিশশাে সাতচল্লিশের কথা। এটা উনিশশাে আটষট্টি। মাঝখানে একুশটা বছর পেরিয়ে গেছে। সেদিনের প্রৌঢ় আহমদ আলী শেখ এখন বৃদ্ধ। বয়স তার ষাটের কোঠায়। বড় ছেলে সাঁইত্রিশে পড়লাে। মেজো’র চৌত্রিশ চলছে। সেজো আটাশ। ছােট ছেলের বয়স একুশ হলাে।
বড় তিন ছেলের ভালাে ঘর দেখে বিয়ে দিয়েছেন তিনি। বউরা সব পরস্পর মিলেমিশে থাকে। একে অন্যের সঙ্গে ঝগড়া করে না, বিবাদ করে না। তাই দেখে আর অনুভব করে কর্তা-গিন্নির আনন্দের সীমা থাকে না। মনে মনে তারা আল্লাহকে ডাকেন। আর বলেন তােমার দয়ার শেষ নেই।
আহমদ আলী শেখের নাতি-নাতনীর সংখ্যাও এখন অনেক। বড়র ঘরে পাঁচজন। মেজোর দুই ছেলেমেয়ে। সেজো পরে বিয়ে করলেও তার ঘরে আটমাসের খুকিকে নিয়ে এবার তিনজন হলাে।
মাঝে মাঝে ছেলে, ছেলের বউ আর নাতি-নাতনীদের সবাইকে একঘরে ডেকে এনে বসান আহমদ আলী শেখ। তারপর, চেয়ে-চেয়ে তাদের দেখেন। একজন চাষি যেমন করে তার ফসলভরা ক্ষেতের দিকে চেয়ে থাকেন তেমনি সবার দিকে তাকিয়ে দেখেনে আহমদ আলী শেখ, আর মনে মনে আল্লাহর কাছে মােনাজাত করেন। ইয়া আল্লাহ, এদের তুমি ঈমান-আমানের সঙ্গে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রেখাে।
এখন রাত। আহমদ আলী শেখ বিছানায় আধশােয়া অবস্থায় রােজকার অভ্যেসমতাে খবরের কাগজ পড়েন।
রাজনৈতিক খবরাখবরে তার কোনাে উৎসাহ নেই। দল গড়ছে। দল ভাঙছে। দফার পর দফা সৃষ্টি করছে। আর বক্তৃতা দিচ্ছে। ভিয়েতনামে ত্রিশজন মরলাে। রােজ মরছে। তবু শেষ হয় না। আইয়ুব খানের ভাষণ। আর কাশ্মির। কাশ্মির। কাশির পড়তে পড়তে মুখ ব্যথা করে উঠে।
জহির রায়হান
জহির রায়হান : জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষা কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট ও আলিয়া মাদ্রাসায়। ফেনীর আমিরাবাদ হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করেন। তার আগেই কলকাতার বিখ্যাত নতুন সাহিত্য পত্রিকায় ‘ওদের জানিয়ে দাও শিরােনামে তার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যােগ দিয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি ও ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক জে এ কারদারের সহকারী হিসেবে। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনাে আসেনি' মুক্তিলাভ করে ১৯৬১ সালে।
ছাত্রজীবনেই তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে তার হাজার বছর ধরে উপন্যাসটির জন্য তিনি আদমজি পুরস্কার লাভ করেন। পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি ‘সঙ্গম' তাঁর হাত দিয়েই তৈরি হয়। ১৯৭০ সালে মুক্তিলাভ করে তাঁর পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া ছবিটি। এটি ছিল এদেশের প্রথম যথার্থ রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ ছবি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তৈরি করেন ‘স্টপ জেনােসাইড' ও ‘এ স্টেট ইজ বর্ন ছবি দুটো। এ সময় গঠিত বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তি পরিষদ’ এর তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি বড় ভাই শহীদ সাংবাদিকঔপন্যাসিক শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন। সাহিত্যকর্মের জন্য জহির রায়হান বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭২) ও স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯২) এবং চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় একুশে পদক লাভ করেন (১৯৭৭)।