তখন বাংলা অঞ্চলে আধুনিক শিক্ষা সবেমাত্র শুরু হচ্ছে। শিশুরা চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চিওয়ালা স্কুলে যাচ্ছে পড়তে। কিন্তু পড়তে গেলেই তো আর হবে না! তাদের পড়ার জন্য তো বই লাগবে! আগে তো বই লাগত না। টোলে বা গুরুর বাড়িতে শিশু-কিশোররা পড়তে যেত। গুরু মুখে মুখে যা বলতেন তাই-ই তারা শিখত। কিন্তু আধুনিক শিক্ষার জন্য চাই বইপত্তর। কিন্তু কে লিখবে বই! এ তো আর বড়দের বই না যে চাইলে অনেকেই লিখতে পারবে!
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর লিখলেন শিশুদের জন্য একের পর এক বই। লিখলেন বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে কথামালা, নীতিবোধ, চরিতাবলী, জীবনচরিত ইত্যাদি মজার মজার সব বই।
বিদ্যাসাগরের ‘কিশোর রচনা’র এই সংকলনে মূলত ছোটদের মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ অর্জনে সহায়ক গল্পগুলোই নেয়া হয়েছে। এসব গল্প পড়ে তারা যাতে বড় মানুষ হওয়ার পথে পা বাড়ায়; বড় পৃথিবীর পথে পা বাড়ায়।
বইতে সংকলিত গ্রন্থগুলোতে বিদ্যাসাগরের বানানরীতিই অনুসরণ করা হয়েছে। যাতে আমাদের তরুণ শিক্ষার্থীগণ তার ভাষারীতির সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
সমাজ সংস্কার, শিক্ষাবিস্তার, দয়াদাক্ষিণ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-৯১) অবিস্মরণীয় ভূমিকার কথা মনে রেখেও রবীন্দ্রনাথ বলেছিঠেন, ‘তাঁহার প্রধান কীর্তি ভঙ্গভাষা’। তিনিই বিদ্যাসাগরকে ‘বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী’ বলে অভিহিত করে বাংলা গধ্যে তাঁর দানের বিস্তার পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। মূল হিন্দি অবলম্বনে বেতালপঞ্চবিংশতি (১৮৪৭) লিখে বাংলাসাহিত্যে বিদ্যভসাগরের যাত্রা শুরু। এরপর তাঁর অনুবাদমূলক সাহিত্যকর্ম শকুন্তলা (১৮৫৪) কালিদাসের অভিজ্ঞানশকুন্তল নাটক এর অবলম্বন। তবে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত নাটককে বাংলায় আখ্যানের রূপ দিয়েছেন মূলে সাতটি অঙ্ক অনুবাদে সাতটি পরিচ্ছেদের রূপ নিয়েছে। মূলে যা ক্রিয়ামূলক, অনুবাদে তা বিবৃতিমূলক, সংলাপ উভয়ই আছে। তবে তার চেয়েও বড়ো পরিবর্তন করেছেন রুচি ও বাস্তবতার বিবেচনায়। কালিদাসের কালে রাজসভায় যে-আদিরসের জোগন সংগত এমনকী আবশ্যিক মনে হতো, উনিশ শতকের পাঠকসাধারণের জন্যে বিদ্যাসাগর তা রুচিকর বিবেচনা করেন নি। ফলে, মূলে যা প্রকট, তা কখনো আভাসে প্রকাশিত, কখনো বর্জিত। এইজন্যে সমালোচকেরা বলেন, কালিদাসের দুষ্মন্ত যেখানে কামুক, বিদ্যাসাগরের দুষ্মন্ত সেখানে প্রেমিক। সংসারানভিজ্ঞা শকুন্তলার ব্রীড়াবনত ভাবটাও বাংলায় চমৎকার ফুঠে উঠেছে।