ভূমিকা ‘কিশোর ছড়া কবিতার রূপ-অরূপ’ নামের গ্রন্থটি প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ গবেষক হাসানরাউফুনের শ্রমসাধ্য অনুসন্ধানের পরিণত দলিল। বাংলাদেশে কবিতা নিয়ে গবেষণা-বিশ্লেষণ-সমালোচনা হলেও ছড়া বা কিশোর কবিতার ক্ষেত্রে তার ঘাটতি পরিলক্ষিত। আমাদের বিশাল শিশুসাহিত্য নিয়েই তেমন কোনো গবেষণা হয়নি। শশুসাহিত্যের অন্তর্গত ছড়া-বিশেষের বিষয়-প্রকরণ গবেষণা কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। আমাদের সাহিত্য নিয়ে যাঁরা বিভিন্ন সময়ে গবেষণা করেছেন, অন্তত বিশ্লেষণাত্মক নিবন্ধ রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে আতোয়ার রহমানের নামই সর্বাগ্রে উর্লেখ করতে হয়। তিনি একাধিক গ্রন্থে ও প্রবন্ধে ছড়াসাহিত্যের সমালোচনা প্রকাশ করেছেন। এছাড়া হায়াৎ মামুদ, প্রণব চৌধুরী, লুৎফর রহমান রিটন, শাহাবুদ্দীন নাগরী, ফারুক নওয়াজ, সুজন বড়ুয়া, আমীরুল ইসলাম, ইলতুত আলীদ, আহমদ মাযহার, রাশেদ রউফ, সন্দীপন মল্লিক, তপন বাগচী, রণদীপম বসু, জুলফিকার শাহাদৎ প্রমুখ লেখক ছড়াসাহিত্য নিয়ে নানামুখী আলোচনা করেছেন। শিশুসাহিত্য নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে গবেষণা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড মনিরা কায়েস এবং বাংলা একাডেমীর ফেলোশিপপ্রাপ্ত সাইফুল ইসলাম। বর্তমানে ইসলামী বিশ্ববিদ্যায়ে বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্য নিয়ে এম.ফিল পর্যায়ে গবেষণা করছেন করছেন উম্মে সালমা অনন্যা। এঁদের গবেষণাকর্ম গ্রন্থিত হলে বাংলাদেশের ছড়াসাহিত্যের উজ্জ্বলতা সম্পর্কে ধারণা নেয়া যেত।
ছড়াসাহিত্য নিয়ে গবেষণার এই সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন তরুণ গবেষক হাসান রাউফুন। একজন ছড়াসাধক হিসাবে এই গবেষকের আন্তরিক সদিচ্ছা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমকে আমরা স্বাগত জানাই।
হাসান রাউফুন তাঁর গবেষণাকে সর্বমুখী করতে যাননি। এই কৌশল গবেষণার ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ফললাভে সহায়ক। ছড়ার অনিবার্য দুটি উপকরণ হলো ছন্দ ও অন্ত্যমিল। হাসান রাউফুন কেবল অন্ত্যমিল নিয়েই রচনা করেছেন নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধ। উচ্চাভিলাষী এই অনুসন্ধানের মাধ্যমে গবেষক বাংলাদেশের ছড়ার মিলের সৌন্দর্য অনুভব করতে গিয়ে গরমিলের সাক্ষাৎও পেয়েছেন। ছড়ার বাক্যগঠন নিয়ে চমৎকার আলোচনা করেছেন গবেষক। তাঁর আলোচনার বিশেষ দিক হলো নমুনা উদ্ধার। ছড়া কবিতার প্রাণ অর্থাৎ অর্থ, ধ্বনি, ছন্দ, রীতি, রস, অলংখার ও কাব্যগুণ নিয়ে তাঁর আলোচনা বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
এতে নবিশ ছড়াকাররা যেমন উপকৃত হবে, প্রতিষ্ঠিত বলে দাবিদার ছড়াকাররাও তেমন উপকৃত হবেন। শব্দ-ব্যবহার নিয়ে গবেষকের আলোচনাও তাৎপর্যমণ্ডিত এইসকল ভিত্তি আলোচনার পরে মূল লক্ষ্যে উপনীত হতে চেয়েছেন। সবল ও দুর্বল মিলের সূত্র একটি দরকারি কাজ। মিলের একটি অভিধানও তিনি তৈরি করে দিয়েছেন। এরকম নানান প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ নিয়ে হাসান রাউফুনের চিন্তা পরিভ্রমণ। ছড়া-গবেষণায় গবেষকের অধিকার ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ নেই। খ্যাতিমান ছড়াকারদের ত্রুটি-দুর্বলতা দর্শনের প্রতিক্রিয়া হিসাবে বিবেচনা করলে হাসান রাউফুনের এই গবেষণা বাংলাদেশে একটি সাহসী কাজ হিসেবে মূল্য পেতে পারে। তাঁর এই গ্রন্থের ত্রুটি-দুর্বলতা নিয়েও আলোচনা-সমালোচনার সুযোগ রয়েছে। আর এভাবেই আমাদের ছড়াসাহিত্য ক্রমশ শুদা্ধতার দিকে এগিয়ে যাবে। হাসান রাউফুন সেই মহৎ কাজের সূচনা করলেন। আরো অনেকেই এভাবে কাজ করে ছড়াসাহিত্য পূর্ণতায় নিয়ে যাবেন। এই কারণেই এই কাজের গুরুত্ব যথেষ্ট।
যাঁরা ছড়া লেখেন, তাঁরা তো বটেই, যাঁরা ছড়া পড়েন, তাঁদের জন্যও এটি একটি দরকারি গাইড-লাইন হতে পারে, আপাতত এই লক্ষ্যপূরণে এটি একটি সফল প্রচেষ্টা।
তপন বাগচী ঢাকা।
সূচি * ছড়া কবিতার বাক্যগঠন * ছড়া কবিতার প্রাণ * ছড়া কবিতার শব্দ ব্যবহার ও বিপর্যয় * ছড়া কবিতার মিল গরমিল * ছড়া কবিতায় যতির ব্যবহার * প্রয়োজনীয় সংযোজন (শব্দ অভিধান) * সমালোচিত কবিগণ