ভারতের খ্যাতিমান লেখক খুশবন্ত সিং-এর প্রথম উপন্যাস ট্রেন টু পাকিস্তান যখন প্রকাশিত হয় তখন তাঁর বয়স ৪১ বছর। এরপর আর থেমে থাকেনি তাঁর কলম। বলা যায় ৯৯ বছর বয়সে মৃত্যুর আগেও তিনি লিখেছেন। তিনি খুশবন্তনামা : দ্য লেসনস অফ মাই লাইফ লিখেছেন তাঁর মৃত্যুর দুই-এক বছর আগে ৯৮ বছর বয়সে। ওই বয়সেও তিনি খেই হারিয়ে ফেলেননি। অভিজ্ঞতার বর্ণনার পাশাপাশি সরস যৌন বক্তব্য, কৌতুক ও পরিহাস সবই আছে খুশবন্তনামা-য়। তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তিনি যেভাবে কথা বলতে অভ্যস্ত ছিলেন, ঠিক সেভাবে লিখতে পারঙ্গম ছিলেন। পাঠককে তিনি বিনোদন দিতেন এবং ক্ষেপিয়েও তুলতেন। খুশবন্তনামা অনেকটা আত্মজীবনীমূলক, এবং এতে রয়েছে আংশিক মন্তব্য, রাজনীতি, দেশবিভাগের বেদনা, যৌনকর্মের সুখ, কবিতা পাঠের আনন্দ এবং মানুষের জীবনে হাস্যরসের প্রয়োজনীয়তা ও তাৎপর্য। এ বইটির ভূমিকায় তিনি বলেছেন, “৯৮ বছর আমি যখন আমার ফেলে আসা জীবনের দিকে ফিরে তাকাই, ভাবি, কোন্ বিষয়গুলো আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে, কী এবং কে আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল; আমি যে ভুলগুলো করেছি এবং আমার অনুশোচনার কথাও মনে পড়ে। লেখার কাজে আত্মনিয়োগ করার আগে একজন আইনজীবী হিসেবে, এরপর কূটনীতিক হিসেবে জীবনের মূলব্যান বছরগুলো অপচয় করার কথা ভাবি। অপরের সঙ্গে ও নিজের সঙ্গে সৎ থাকার জন্য করণীয় সম্পর্কেও ভাবি। আমার জীবনের উত্থান-পতন ছিল। কিন্তু সবকিছুর মধ্য দিয়েই জীবন কাটিয়েছি এবং আমি মনে করি, এসব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি।” খুশবন্তনামা-য় তিনি নিজেকে উপস্থাপন করেছেন এভাবে : “আমি দুঃখজনক উপসংহারে উপনীত হয়েছি যে, আমি বরাবর একটু লম্পট স্বভাবের ছিলাম। আমার চার বছর বয়স থেকে এখন আমার সাতানব্বই বছরের শেষ পর্যায়েও এই লাম্পট্যই আমার মনে সর্বোচ্চ স্থান দখল করে ছিল। নারীদের সম্পর্কে ভারতীয় দর্শনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমি কখনো তাদেরকে মা, বোন বা কন্যা হিসেবে ভাবতে পারিনি। তারা যে বয়সেরই হোক-না কেন, আমার কাছে তারা লালসার বস্তু হিসেবে ছিল এবং এখনো আছে।” মৃত্যুর কয়েক বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, কোন্ বিষয়টি থেকে তিনি সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত বলে অনুভব করেন। তাঁর উত্তর ছিল, উপভোগ্য যৌনসঙ্গম। যেদিন তুমি যৌনকর্ম করতে অক্ষম, সেদিনই বুঝতে হবে একজন পুরুষের পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার সময় এসেছে। কিন্তু হ্যাঁ, এখনো আমি সেসব কল্পনা করি।;'
খুশবন্ত সিং
খ্যাতিমান ব্যক্তিদের আত্মজীবনীও সাধারণভাবে একঘেঁয়ে ও ব্যাপকভাবে বিরক্তিকর। কারণ আত্মজীবনীর লেখকরা নিজেদেরকে তারা যা ছিলেন প্রায় ক্ষেত্রেই তার চেয়ে বড় দেখাতে চেষ্টা করেন এবং চারপাশে সংঘটিত সবকিছুর সাথে নিজের ভূমিকাকে প্রধান করে তােলেন । কিন্তু খুশবন্ত সিং এর আত্মজীবনী টুথ লাভ অ্যান্ড অ্যা লিটল ম্যালিস এর ব্যতিক্রম । ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভক্তির উপর তার ট্রেন টু পাকিস্তান’ কালজয়ী এক উপন্যাস যেটি ১৯৫৬ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং ছয় দশক পরও এটি জনপ্রিয় একটি উপন্যাস। খুশবন্ত সিং-এর পরিবার নয়াদিল্লির অন্যতম নির্মাতা। আত্মজীবনীতে পারিবারিক ইতিহাস ও স্মৃতিচারণ ছাড়া উঠে এসেছে লন্ডনের কিংস কলেজে তার যাপিত সময় লাহােরে আইন ব্যবসা পদশভাগ, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যােগদান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সম্পর্কের বিষয়গুলাে । আধুনিক ভারতের ইতিহাসের উল্লেখযােগ্য ঘটনা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন কাছে থেকে। নিজের জীবনী লিখতে তিনি নিজের ত্রুটিবিচ্যুতি আড়াল করেননি এমনকি নিজের প্রথম ব্যর্থ যৌন উদ্যোগের ঘটনাও পাঠকদের জানিয়েছেন । ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র সঞ্জয় গান্ধী বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর তার স্ত্রী মানেকার সাথে ইন্দিরা গান্ধীর বৈরি সম্পর্কের একটি অধ্যায় আত্মজীবনী প্রকাশিত হওয়ার আগেই সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ইন্ডিয়া টুডে প্রকাশ করে । মানেকা গান্ধী এর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকেন এবং আদালত খুশবন্ত সিং-এর আত্মজীবনী প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করলে দীর্ঘ পাঁচ বছর পর্যন্ত স্থগিত থাকে গ্রন্থটির প্রকাশনা। প্রকাশনা বিলম্বিত হলেও আদালত লেখকের মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে সীমারেখা টেনে দেয়নি। খুশবন্ত সিং এর উপন্যাস পাঠকরা যেমন রুদ্ধশ্বাসে পড়েন তার আত্মজীবনীও একইভাবে পাঠককে টেনে নিয়ে যায় এক ঘটনা থেকে আরেক ঘটনায় । টুথ লাভ অ্যান্ড অ্যা লিটল ম্যালিস ভারতে প্রকাশিত হওয়ার এক বছর পরই ২০০৩ সালে এটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ২০১৭ সালে নালন্দা প্রকাশনী' এটির নতুন সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ অত্যন্ত প্রশংসনীয়।