"কাঙালসংঘ" বইটির প্রথম অংশের লেখাঃ
নগরের ঝকঝকে আধুনিকতা নেই, আবার গ্রামের কোমলতাও নেই। শহরের পাশে খােসপাঁচড়ার মতাে গড়ে ওঠেছে একটা বস্তি। এখানে ঘুম ভাঙে কলহে, ঘুম আসে কান্নায়। ভাঙাচোরা ঘরগুলাে যত কাছাকাছি আছে, মানুষগুলাে থাকে ততই দূরে। স্বার্থপরতা তাদের টিকে থাকার মন্ত্র, নিঃস্বার্থ হওয়ার মতাে সামর্থ্যও তাদের নেই। টিকে থাকাটাই এখানে সাফল্য। তবুও কিছু মানুষ দারিদ্র্য আর বঞ্চনার এই কারাগার থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখে। নিয়তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তারা এবং অহরহ পরাজিত হয়। বিদ্যুতের পক্ষপাতদুষ্টতার কারণে মােমবাতির আলােয় এই নােংরা বস্তির এক ভাঙা ঘরে পাঁচজন নিঃস্ব মানুষ সভা বসিয়েছে। একটা পরিকল্পনা ছাড়া তাদের আর কিছুই নেই। এই সভার মধ্যমণি একজন জেলখাটা আসামি।
জেলখানায় আনাড়ি হয়ে ঢুকে। অপরাধের সব কলাকৌশল রপ্ত করে বের হয়েছে সে। একপাশে ঘােলা দৃষ্টি মেলে মােমবাতির কম্পমান শিখাটা দেখছে যে, সে একজন নেশাখাের এবং প্রতারক। তার জন্ম হয়েছে রাস্তায়, রাস্তাই তাকে বড়াে করেছে। কিছুদিন আগেও সে অজ্ঞানপার্টির সদস্য ছিল; সম্প্রতি বহিষ্কৃত। দলছুট হয়ে এখন একাই ছলনা, প্রতারণা, ছিনতাই করার চেষ্টা করে এবং প্রায়শই ব্যর্থ হয়। মুখে বার্ধক্যের এবং দ্বিধার অসংখ্য রেখা নিয়ে যে লােকটি বসে আছে, একসময় সে ডিস্ট্রিক ট্রাকের ড্রাইভার ছিল, চোখে ছানি পড়ায় এখন ভিক্ষা করে বেড়ায়। এই সংঘের একমাত্র নারী সদস্যটি একজন কমবয়সি পতিতা। সিনেমা হলের সামনে যৌবনের ফাঁদ পেতে শিকার ধরে সে। ঘরের সবচেয়ে অন্ধকার কোনায় যে ছেলেটি নিষ্প্রভ হয়ে বসে আছে, এই শহরে সে একেবারেই নবীন। জীবনে প্রথমবার বাসে চড়ে এই শহরে এসেছে সে। দুই পুরুষ ধরে তারা পরাশ্রয়ী। এক খণ্ড ভূমির জন্য হাহাকার সে পৈতৃক সূত্রে পেয়েছে। ভূমির আশায় সে শহরে আসেনি, তার চেয়েও মূল্যবান কিছু ছিল তার। সেই হারানাে সম্পদের খোঁজ তাকে বস্তির এই ঘরে এনে ফেলেছে। এই অভাগা ছেলেটির নাম হচ্ছে মনা। সে জন্ম থেকেই রাখালপাড়া নামক গ্রামে বসবাস করে এসেছে। হয়তাে মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই থাকত; কিন্তু এক শান্ত সকালে তার জীবনের গতিপথ পাল্টে যায়। দরিদ্র সে আগেও ছিল, সেদিন সে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়। রাখালপাড়া থেকেই গল্পটা শুরু করা যাক।