কালো বরফ
বইবাজার মূল্য : ৳ ২০০ (২০% ছাড়ে)
মুদ্রিত মূল্য : ৳ ২৫০
প্রকাশনী : সাহিত্য প্রকাশ
বিষয় : সমকালীন-উপন্যাস
This book is Out of Stock
#বইবাজার_রিভিউ_প্রতিযোগিতা_মার্চ_২০১৯ কালো বরফ ক. ‘কালো বরফ’ নামের একটা বই অনেকবার চোখে পড়ছে। প্রথম যখন ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরীর সদস্য হই, তখন। এমনকি অনলাইন বইয়ের ওয়েবসাইট গুলোতেও। কিন্তু ‘স্টারডম’ নামক নেশায় আমিও বুঁদ। সুনীল, সমরেশ, রবীন্দ্রনাথ কিংবা খুশবন্ত সিং-দের মত নামী লেখকদের বই বাদ দিয়ে কোথাকার কোন মাহমুদুল হকের বই কে পড়ে! হঠাৎ এক বড় ভাইয়ের লেখার কল্যাণে নতুন করে চোখে পড়ল ‘কালো বরফ’ এবং সত্যি বলব, স্টারডমের নেশা তখনও আমার কাটেনি। তাই ‘কালো বরফ’ নিয়ে সেই লেখাটি কিংবা কমেন্ট পড়িনি। কিন্তু ‘কালো বরফ’ নিয়ে তিনি মুগ্ধ সেটা জানতাম। যাদের ‘রেকমেন্ডেশন’-এ ভরসা আছে এই লেখাটি তাদের মধ্য থেকে একজনের। তাই ভেবেছিলাম পড়বো একদিন এবং পড়লাম। খ. গল্পটা এক ছা-পোষা অধ্যাপকের। গ্রামের কলেজে শিক্ষকতা করেন তিনি। এক সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে তার সংসার। কিন্তু ক্ষ্যাপা স্বভাবের লোকটা টাকা পয়সা নিয়ে ভাবে না একদম। রাত জেগে খসখস করে কিসব লেখে, আর মাঝে মাঝে কাঁদে। দিনের বেলা স্ত্রী দেয় খোঁটা। ‘মাধুকরী’-র পৃথু ঘোষের সাথে অদ্ভুত মিল। এ যেন আরেক পৃথু ঘোষের সাথে পরিচয় হল আমার। ‘কালো বরফ’-এর শুরুটা উত্তম পুরুষে। কথক তার ছেলেবেলার কথা বলছে। ছেলেবেলা না, বরং বলতে হয় যে একদম শিশুবেলা। একটা শিশুর মনোলোক আর তার বেকুবি কাজ কারবার নিয়ে যে এমন আবেশ তৈরি করা যায়, তা কালো বরফ না পড়লে বুঝতাম না। কিন্তু মুগ্ধতা এখানেই শেষ না, শেষ হয় না গল্পেরও। কেননা গল্পের পেছনে আছে আরও কিছু গল্প। কিছু কষ্ট। নিয়তির নিয়ম মেনেই তাদের সংগঠন। আবদুল খালেকের বসত ছিল যেখানে, তার বর্তমান নাম পশ্চিম বাংলা। সেখানে কেটেছে তার ছেলেবেলা। অনেক স্মৃতি জমে আছে তার, সেখানে। মেজো ভাই মনির অনেক বাঁদরামোর স্মৃতি। সে সব ফিরে ফিরে আসে আবদুল খালেকের মনে। মায়ের সংসার টেনে যাওয়ার স্মৃতি। হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসা ভেকধারী সাধুর স্মৃতি। কিছু ভালোলাগা, ভালোবাসার স্মৃতি। স্মৃতি পিপীলিকা যেন ঘিরে ধরে তাকে। ভুলে যায় সংসার, যাপিত জীবনকে। আবদুল খালেককে ছেড়ে আসতে হয়েছিল সেই ভূমি। কেবল আবদুল খালেক তো নয়, ছাড়তে হয়েছিল অনেককেই। তাদের মাঝে একজন হয়ত আবদুল খালেক। ভিটে ছেড়ে চলে আসার সময় স্টিমারে আবদুল খালেক দাঁড়িয়ে ছিলেন তার মেজো ভাইয়ের পাশে। তার হাতে ধরা ছিল, এক বালিকার চুলের ফিতে। কেবল ওই টুকুই নিয়ে আসতে পেরেছিলেন তিনি। গ. ব্যাক্তির মন চিড়ে ভেতরে যে আরেক মন থাকে, সেই মনের ছবি তুলে এনেছেন মাহমুদুল হক। আবদুল খালেক কোন একজন মানুষ নন। তার মত, আরও অনেক মানুষ বেঁচে থাকে মনের ভেতর হাজারটা স্মৃতি, হাজারটা কষ্ট লুকিয়ে। বুকের ভেতর গুমরে কান্নার সে গল্প সব সময় লেখা হয় না। ছা-পোষা মানুষের গল্পেরা চেপে বসে থাকে বুকে। মাহমুদুল হকের লেখার হাত অসাধারণ। প্রতিটা জিনিস এমন ভাবে লিখেছেন, যেন তা আমার সামনে ঘটছে। কিংবা, আমিই আবদুল খালেক। অদ্ভুত সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন তিনি, খালেকের ছেলেবেলার। তার অন্তর্দ্বন্দ্ব হয়ে উঠেছে মূর্ত। এমনকি ছা-পোষা মানুষের জীবনেও প্রেম থাকে, রোমান্টিকতা থাকে। একটুখানি কোট করি “আবদুল খালেক রেখার ব্লাউজের বোতাম খুলে দিয়ে একটা হাত রাখল সেখানে। বললে, ‘এতো নরম, এতো মায়া!’ রেখা বললে, ‘তোমার ভালো লাগে?’ ‘মরে যেতে ইচ্ছে করে’ ‘তুমি তো আজকাল দ্যাখোই না। টুকু হওয়ার পর তোমার যেন আর ভক্তি নেই’ ‘টুকু যখন তোমার কোলে এলো, তোমাকে দেখলাম, গর্ব হল, তুমি কি সুন্দরই না হয়েছ। যখন কোলে নিয়ে বসে থাকো, নানান ছলচাতুরী করে তোমাকে দেখি। মনে হয় জীবনভর দেখি। আগে দেখতাম শুধু চোখ দিয়ে, এই প্রথম আমার মন দিয়ে দেখতে শেখা’ ঘ. সংসার জীবন আর যাপিত জীবনের প্রতিদিনের ঘটনা থেকে সরে যাওয়া একজন মানুষের মাধ্যমে মাহমুদুল হক ‘কালো বরফ’-এ আমাদের দেখিয়েছেন দেশভাগ, হিন্দু মুসলমান সম্পর্কের সেই সময়কে। ভিটে ছেড়ে আসা মানুষ আর তাদের স্মৃতির কথা লিখেছেন মাহমুদুল হক। উপন্যাসে তিনি দেখিয়েছেন এসব রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক বিষয় কোথাও তেমন দানা বাঁধে না, অথচ শেষ পর্যন্ত এই দেশ ভাগই এক স্থায়ী প্রভাব ফেলে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র আবদুল খালেকের উপর। আবদুল খালেক তার স্মৃতির হাত থেকে মুক্তি পান না, পাবে না হয়ত তার মতো কোন মানুষই। ব্যক্তিগত জীবনে মাহমুদুল হক নিজেও ছিলেন এমন ছেঁড়া-স্মৃতির মানুষ। দেশভাগের উত্তাল সময়ে তাকে জন্মভূমি বারাসত ছেড়ে চলে আসতে হয় ঢাকায়। এই ঘটনার অভিজ্ঞতা তার সাহিত্য সৃষ্টিতেও ব্যাপক প্রভাবিত করেছে। তিনি আজীবন প্রায় নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করেছেন। ‘কালো বরফ’-এর আবদুল খালেকের সাথে তার নিজের মিল অনেক। হয়ত নিজের সেই স্মৃতি, বেদনা তিনি প্রকাশ করেছেন আবদুল খালেকের গল্পে। মাহমুদুল হকের গদ্য অসাধারণ। ‘কালো বরফ’ একজন পরিণত পাঠককে মুগ্ধ করবে। মাহমুদুল হক সম্পর্কে বলতে গিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছিলেন, “বাংলা গদ্যে প্রভুত্ব করার ক্ষমতা এর আছে”। ‘কালো বরফ’ সেই প্রতিভার প্রামাণ্য রূপ।