মুসলিম বিশ্বাসে স্বাস্থ্যকর বুদ্ধিবৃত্তির যে সবাক ঐহিত্য, তার সুরম্য এক স্থাপনা কালামশাস্ত্র। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে জ্ঞানপরিসরে এর সক্রিয়তা। কালামের দাবি, ওহীর সত্যে বুদ্ধি ও মস্তিষ্কের যে সমর্থন, তাকে সে ভাষা দান করে। প্রতিটি কাল যেসব চোখরাঙানি দিয়ে সত্যবিশ্বাসকে ভীত করতে চায়, কালাম সে সবের সাথে লড়াই করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সত্যের পাহারায় আপন সক্ষমতা প্রদর্শনে তার আত্মগঠন।
ইসলামের বোধ-বিশ্বাসের সীমান্ত প্রহরী হিসেবে কালাম নিজের পরিচয় হাজির করলেও মানবসভ্যতার চিন্তা-ঐতিহ্যকে সে এমন মোচড় দিয়েছে, যার ফলে বুদ্ধিবৃত্তির পৃথিবী আর আগের পৃথিবী থাকেনি। মুসলিম জ্ঞানকলার একান্ত উপাদান হলেও কালাম খ্রিস্ট্রিয় চিন্তারাজ্যে একদা যেমন চিত্তপ্লাবন ডেকে এনছিলো, তেমনি এনেছিলো ইহুদী মানসে।
আজকের দুনিয়ায় মুসলিম বিশ্বাস, চিন্তাসংগঠন ও মনোজাগতিক বিকারের রোধে তার প্রয়োজনীয়তা শতাব্দীর এপার-ওপারে নিনাদিত। কেননা মুসলিম দুনিয়া আধুনিকতা,উত্তরাধুনিকতা, উত্তর-উত্তরাধুনিকতার বিরতিহীন চিন্তাতরঙ্গে এখন একটি বিশ্বগ্রামে সভ্যতার সংঘাতের মুখোমুখি। যে সংঘাত যতোটা দৃশ্যমান, তার চেয়ে অনেক বেশি অদৃশ্য। দেশের ভূমি দখলের চেয়ে মনের জমি দখলে এ সংঘাত অধিক সক্রিয়। সভ্যতা-সংস্কৃতির অস্ত্র হিসেবে এখানে সব চেয়ে বেশি নিক্ষিপ্ত হচ্ছে চিন্তা, চিন্তা, চিন্তা...
এরকম একটি রণমত্ত মাঠ কালামের শক্তিপ্রদর্শনের জায়গা। সে ইসলামের হয়ে কথা বলবে, লড়বে। কিন্তু একুশ শতকের রণাঙ্গণের সাথে তার পরিচয় কি প্রশস্ত? কালাম অতীতে যে পরাক্রম প্রদর্শন করেছিলো, এখন এর প্রয়োজন তীব্র হলেও এর রূপায়ন কোথায়?
এই রূপায়নের পথে কালাম নিজেকে নবায়ন করতে চায়। আপন পরিচয়ে ও স্বাতন্ত্রে হাজির হতে চায়।
এ বই মূলত কালাম দর্শনের সাথে পাঠকের যোগাযোগের দরোজা উন্মোচন। কালামের পরিচয়, পরিসর, ইতিহাস, অন্যান্য দর্শনের সাথে ইতোপূর্বে তার বুঝাপড়া, তার পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক এবং যে পথ পাড়ি দিয়ে সে এসেছে, যে সব ধারা -উপধারা তাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে, তাদের যে সব চিন্তা, সক্রিয়তা ও আলোচনা-উত্তাপ এবং এসবের ফলে বিশ্বসভ্যতায় কী ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ঘটেছে , তার বাখান রয়েছে এ গ্রন্থে। আধুনিক কালামের নবজাগরণ প্রয়াস নিয়েও এতে রয়েছে আলোকপাত ও স্থাপত্যনির্দেশ। বইটি পেশ করতে চেয়েছে প্রাচীন কালামকে নবায়নের এক রূপকল্প।
তার আলোকে এই একুশ শতকে কালামী আলোচনার বিন্যাসে প্রয়াসী হবে এ ধারার পরবর্তী বই; ইসলামের দার্শনিক ভাষ্য। ইন শা আল্লাহ!
এ বই তৈরী হয়েছে বই হবে বলে নয়। কালাম বিষয়ক আমার কতিপয় আলোচনা অনুলিখন করেন মাওলানা আলাউদ্দীন রফিক। আলোচনাগুচ্ছে নিহিত ছিলো কিছু হয়ে ওঠার সম্ভাবনা। প্রিয় অনেকের অনুরোধে সেগুলোকে পরিবর্ধিত ও বিন্যস্ত করি ক্রমে ক্রমে। তার ফলাফল এই বই। পরিবর্ধনের ফলে সেটা আর আলোচনাগ্রন্থ থাকেনি। তবে আলোচনার মেজাজটা থেকে গেছে। যা নানা ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তি এড়াতে পারেনি।
বাংলা ভাষায় কালামসংক্রান্ত অধ্যয়ন ও অনুশীলনে এ বই নতুন বাস্তবতার স্বপ্ন দেখে। বইটি পাঠকের সেই বিবেচনাকে সম্বোধন করে কথা বলেছে, যা জ্ঞান ও চিন্তাকে উদযাপন করতে চায় সত্যের জন্য।