বর্তমান সময়কে ছিঁড়েখুঁড়ে তুলে আনার দুর্মর প্রচেষ্টা আলোচ্য উপন্যাসে দৃশ্যমান। সময়ের আরশিতে বর্তমান যে বাংলাদেশকে আমরা দেখি, যে অস্থির, অনাকাঙ্ক্ষিত এক বাংলাদেশ দৃশ্যমান হয় আমাদের চোখে, লেখক সে চিত্রটিই বিশ্বাসযোগ্যভাবে বয়ানের প্রয়াস পেয়েছেন এই জলতৃষ্ণায়। উপন্যাসের শুরুতে অমরা পাই আবহমান গ্রামবাংলার এক চেনা গ্রামের প্রতিনিধি মকছুদপুর গ্রামকে। নগরায়নের অশুভ ছায়া যে গ্রামটিতে ফেলতে শুরু করেছে তার অশুভ ছায়া, দখল হয়ে যাচ্ছে গ্রামের পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া প্রাচীন খাল, দখল হয়ে যাচ্ছে কৃষিজমি, লুট হয়ে যাচ্ছে কৃষকের চিরচেনা সরল গ্রাম্যজীবন। সেখানে ঢুকে পড়ছে আধুনিকতার কালো ধোঁয়া, শিল্পের চাতুর্য। যা গ্রামবাংলার কৃষককে নিজ জমি থেকে উচ্ছেদ করছে, বাধ্য করছে তার আদিম পেশা কৃষিকাজ ছেড়ে প্রবাসজীবনে উৎসাহী হতে। তবু আতেক আলীর মতো কেউ কেউ প্রবল বিদ্রোহে ঘুরে দাঁড়াতে চায়, শিক্ষিত যুবক রেজওয়ান তথা ঋজুকে সঙ্গে নিয়ে যে হাল ধরতে চায় এই বৈরি স্রোতের বিষম-বিরুদ্ধতার। ঋজু, যে পড়াশোনা শেষে চেষ্টা করে স্বনির্ভর হওয়ার, মাছচাষের প্রশিক্ষন নিয়ে নিজের বাড়ির এজমালি পুকুরটিতে মাছ চাষ করে আর্থিক অনটন ঘোচানোর। কিন্তু তার পুকুরে বিষপ্রযোগে মাছ চাষের ব্যবসায় লালবাতি জ্জালায় কে বা কারা, যেমন ইতোপূর্বে তারা লাটে তুলেছিল তার ছাগল পালন কর্মসূচিটিকেও। এখানে দেখা মেলে ঐশানীর মতো স্রোতের বিপরীতে দাঁড়ানো সাহসী এক যোদ্ধা নারীর। পড়াশোনার পাট চুকিয়ে যে চাকরি না খুঁজে স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করে, চেষ্টা করে সমাজের বেকার সমস্যা সমাধানের। মৃত বাবার রেখে যাওয়া পঞ্চাশ হাজার টাকা আর একখণ্ড জমি নিয়ে যে শুরু করে গার্মেন্টস ব্যবসার। কিন্তু তার গার্মেন্টসের পাশে দুই শিল্পপতির সুউচ্চভবন, তারা বহুগুণ দামে চেষ্টা করে এই জমিটিকে কিনে নিতে, ঐশানীর আপত্তিতে না পেরে অবশেষে রাতের অন্ধকারে আগুন লাগিয়ে দেয় এই গার্মেন্টসে, উপরন্তু হত্যার অভিযোগে ঐশানীকেই ঢুকিয়ে দেয় জেলে। ফলে মাঠে মারা যায় ঐশানীর স্বপ্ন, রেজওয়ান তথা ঋজুর অনলাইন ব্যবসার প্রচেষ্টা।
পাণ্ডুলিপিটিতে দেখা মেলে শফিউল নামক ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার, যে বাংলাদেশের পঞ্চাশবর্ষ পূর্তির কেককাটার অনুষ্ঠানে মুখ ফসকে বলে বসে, আজ দেশের পঞ্চাশ, আমারও পঞ্চাশ!’ এই নিদারুণ তামাশার চিত্রটি বর্তমান বাংলাদেশে অহরহই দেখতে পাওয়া যায় এখন, সরকারি চাকরিতে যারা দখল করে রাখে উল্লেখযোগ্য কোটা, মাস গেলে নেয় মোটা অংকের ভাতা। অথচ প্রকৃত, বয়স্ক মুক্তিযোদ্দারা থেকে যান লোকচক্ষুর আড়ালে। উপন্যাসে এমন অসংখ্য বিচ্যুতি উঠে এসেছে যা মূলত এই সময়ের বাংলাদেশের এক কুশলী চিত্রায়ন। সমাজের অনাচার আর অসঙ্গতিগুলিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার এক সাহসী বয়ান' জলতৃষ্ণা '
শাহমুব জুয়েল
শাহমুব জুয়েল জন্ম ০৯ জানুয়ারি, ১৯৮৫ খ্রি. চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার হাঁসা গ্রামে। লেখকের সম্পাদিত লিটলম্যাগ ‘বর্ণিল’। কবিতাগ্রন্থ : ‘কাঁচা রোদের সন্ধানে’ (২০১৭), ‘মুখোমুখি আহ্লাদী চিবুক’ (২০১৭), ‘বাংলা ব্যাকরণ : উচ্চমাধ্যমিক বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি’ (২০১৭), ‘উচ্চমাধ্যমিক সৃজনশীল বাংলা প্রথম পত্র’ (২০১৭); গল্পগ্রন্থ : ‘অথৈ সময়ের শ্বাস’ (২০১৮); প্রবন্ধগ্রন্থ : ‘কথাসাহিত্যে রাজনৈতিক দর্শন ও বিবিধ প্রবন্ধ’ (২০১৯); উপন্যাস : ‘সবুজডানা’ (২০২০), ‘সমুদ্রগামিনী’ (২০২০), ‘গিরিকন্যা’ (২০২১), ‘মেঘ বিদায়ের দিন’ (২০২২)। তিনি শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। ¯স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পত্রিকায় কবিতা, গল্প, সাহিত্যসমালোচনা, নিয়মিত কলাম ও ফিচার লিখছেন। টেলিভিশনে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছেন।