ফ্ল্যাপের কিছু কথাঃ জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাককে চলমান বিশ্বকোষ বললে খুব একটা অত্যুক্তি করা হয় না। অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম-সংস্কৃতি এই সবগুলো বিষয়ে তিনি বিশেষজ্ঞের মতো মতামত দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। সমকালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাপীঠসমূহের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অনেকেই একবাক্যে তাঁর মেধা এবং ধী-শক্তির অনন্যতা স্বীকার করে নিয়েছেন। এই নিভৃতচারী, অনাড়রম্বর জ্ঞানসাধক মানুষটি সারাজীবন কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি। সভ্য-সমিতিতে কথাবার্তা বলারও বিশেষ অভ্যাস তাঁর নেই। তথাপি এই কৃশকায় অকৃতদার মানুষটি তাঁর মেধা এবং মনন শক্তি দিয়ে জাতীয় জীবনের সন্ধিক্ষণ এবং সংকটময় মুহূর্তসমূহে পথ নির্দেশ করেছেন। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, বলতে গেলে, চারটি দশক ধরেই তরুণ বিদ্যার্থীদের অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন।
সকলেই স্বীকার করেন অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক একজন প্রবাদতুল্য পুরুষ। কিন্তু তাঁর জ্ঞানচর্চার পরিধি কতদূর বিস্তুত, আর তিনি ব্যক্তি মানুষটি কেমন সে বিষয়েও মুষ্টিমেয় অনুরাগীদের বাইরে অধিক সংখ্যক মানুষের সম্যক ধারণা নেই। যদ্যপি আমার গুরু গ্রন্থটি পাঠক সাধারণের মনে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের মনীষা এবং মানুষ আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কে একটি ধঅরণা গঠন করতে অনেকখানি সাহায্য করবে। এই গ্রন্থের লেখক আহমদ ছফা আমাদের সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তিনি অধ্যাপক রাজ্জাকের ছাত্র। দীর্ঘদিন মেলামেশা করার ফলে অধ্যাপক রাজ্জাককে খুব ঘনিষ্ঠভঅবে দেখার যে দুর্লভ সুযোগ তাঁর হয়েছে, বর্তমান গ্রন্থ তার প্রমাণ। অধ্যাপক রাজ্জাকের ওপর খোলামেলা, তীক্ষ্ণ, গভীর এবং সরস এমন একটি গ্রন্থ রচনা করা একমাত্র আহমদ ছফার পক্ষেই সম্ভব। লেখক অধ্যাপক রাজ্জাকের উচ্চারিত বাক্যের শুধু প্রতিধ্বনি করেননি, ব্যাখ্যা করেছেন, উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করেছেন, প্রয়োজনে প্রতিবাদও করেছেন। এখানেই গ্রন্থটির আসল উৎকর্ষ। অধ্যাপক সমকালীন বিশ্বের কথা বলেছেন। সামাজিক দলিল হিসেবেও গ্রন্থটির প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
আহমদ ছফা
আহমদ ছফার জন্ম ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রাম জেলার চান্দনাইশ থানাধীন গাছবাড়িয়া গ্রামে, এক কৃষিজীবী পরিবারে। বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। স্কুল ও কলেজের লেখাপড়া যথাক্রমে চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন, যদিও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানে। সমাজবিজ্ঞান নিয়ে কিছুদিন পদ্ধতিগত গবেষনা করেন। কিন্তু অচিরেই তা ছেড়ে দিয়ে মৌলিক রচনা ও চিন্তাচর্চায় আত্মনিবেশ করেন। মাঝে মাঝে স্বল্প সময়ের জন্য সাংবাদিকতা, পত্রিকা প্রকাশ, প্রেস ব্যবসা বা এনজিও কার্যক্রমকে পেশা হিসেবে নিলেও, আজীবন লেখালেখিই ছিল তার মূল কাজ। ছাত্রাবস্থায়ই লিখেছিলেন সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস, যদিও তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই একটি উপন্যাস সূর্য তুমি সাথী। প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, উপন্যাস, অনুবাদ-কর্ম, শিশু-কিশাের সাহিত্য ইত্যাদি মিলিয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিরিশের অধিক। তাঁর পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ উপন্যাসটি জাপানি ভাষায় ও ‘বস্তি উজার কবিতাটি জার্মান ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এ ছাড়া ওঙ্কার সহ বেশ কিছু লেখা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ওঙ্কার উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়িতও হয়েছে। তিনি বেশ কিছু গানও লিখেছেন। গ্যোতের ফাউস্ট কাব্যনাট্যের বঙ্গানুবাদ তাঁর এক অমর কীর্তি। প্রতিষ্ঠানবিরােধী ও প্রতিবাদী বক্তব্যের জন্য আজীবন তিনি ছিলেন আলােচনা ও বিতর্কের কেন্দ্রে। পাশাপাশি নতুন প্রতিভা আবিষ্কার ও তার লালন এবং নবীনদের মধ্যে চিন্তা উসকে দেওয়ার ব্যাপারেও তাঁর জুড়ি ছিল না। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন, যদিও এই সংগঠনের দেওয়া পুরস্কারও তিনি গ্রহণ করেন নি। সমাজের বঞ্চিত শিশুদের জন্য শিল্পী সুলতান পাঠশালা প্রতিষ্ঠা তার অন্যতম কীর্তি। মৃত্যু : ২০০১ সালের ২৮ শে জুলাই, ঢাকায়।