ফ্ল্যাপের কিছু কথাঃ “....... আমার মা স্থিরচোখে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেই সন্ধ্যেবেলায় আমার একজন অতি সাধারণ নিরীহ মা পৃথিবীর সবচেয়ে অসাধারণ মানুষে পাল্টে গেলেন। তাঁর বুকে জম্ম নিল সিংহীর সাহস, তাঁর স্নায়ুতে হাজির হল ইস্পাতের দৃঢ়তা, তাঁর মস্তিষ্কে এল শতবর্ষী তপস্বীর ধী শক্তি, বুকে বানের মতো ফুলে-ফেঁপে উঠল সন্তানদের জন্যে ভালোবাসা। মাতব্বরের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বললেন, আপরার ভয় নেই। আমি আমার ছেলে-মেয়ে নিয়ে এখনই চলে যাব। ভর সন্ধ্যাবেলা একটা নৌকা ডাকিয়ে আনা হল। ভাই-বোনদের নিয়ে আমার মা নৌকায় উঠে বসলেন। মাঝি নৌকা ছেড়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব গো মা? আমার মা কিছু না বলে চুপ করে পাথরের মতো বসে রইলেন, কী বলবেন, মা তো নিজেও জানেন না কোথায় যাবেন।.......” একাত্তরের পর আমাদের অনিশ্চিত জীবনের কথা লিখতে গিয়ে এভাবে আমার মায়ের কথা লিখেছিলাম। তারপর বহুকাল কেটে গেছে কিন্তু এখনও আমার মায়ের তাকালে মাঝে মাঝে মনে হয় কোনো এক মাঝি বুঝি তাঁকে জিজ্ঞেস করছে, কোথায় যাব গো মা? মনে হয় আমার মা এখনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে আছেন। মনে হয় ভাবছেন তিনি কোথায় যাবেন। একজন মায়ের পথ চলা বুঝি কখনোই শেষ হয় না। “জীবন যে রকম” তার সেই পথ চলার কিছু ছবি। কিছু গল্প। -মুহাম্মদ জাফর ইকবাল
ভূমিকা আমেরিকায় ছেলের কাছে বেড়াতে এসেছি, অফুরন্ত অবসর। সময় কাটানোর জন্যে তাদের কম্পিউটারের দেশে নাতনিদের কাছে চিঠি লিখি।দেখে ছেলে এবং বউমা বলল, আপনার মতো বৈচিত্র্যময় ঘটনাবহুল জীবন আর কয়জন দেখেছে, সেটাই লিখে ফেলেন না কেন? আমাদের ছেলেমেয়রা বড় হয়ে পড়বে। তাদের কথায় লিখতে শুরু করেছিলাম।‘জীবন যে রকম’ আমার সেই চেষ্টার ফল। ভূমিকায় একটা ছোট জিনিস বলে নেয়া দরকার। চেষ্টা করেছি জীবনের শুধু সেইসব ঘটনার কথা উল্লেখ করতে যেগুলো একালে দশজনের কাছে বৈচিত্র্যময় মনে হতে পারে, তবু স্থানে স্থানে একান্ত পারিবারিক কথা এসেছে সেটা বেশির ভাগ সময়েই রেখে দিয়েছি দুটি কারণে। প্রথমত, বাংলাদশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হবার পর তার শৈশব, তার ব্যক্তিগত ইতিহাস শুনতে অনেকে আমার কাছে এসেছে, তাদের কৌতূহল নিবৃত্ত করার একটু চেষ্টা। দ্বিতীয়ত, শৈশবে যাদের ভালোবাসায়অ সে বড় হয়েছে কিন্তু তার স্মরণে নেই বলে যাদের কথা সে ‘আমার ছেলেবেলা’ বইয়ে লিখতে পারেনি, তাদের প্রতি তার হয়ে আমার কৃতজ্ঞতায় প্রকাশ করার এটি একটি আন্তরিক প্রচেষ্টা। সবশেষে পাণ্ডুলিপি ছাপার উপযোগী করে দাঁড় করিয়ে দেয়ার জন্যে আমার ছেলে মুহম্মদ জাফর ইকবালকে অনেক ধন্যবাদ। আয়েশা ফয়েজ ২১ অক্টোবর, ১৯৯১ টিনটিন ফলস নিউ জার্সি
আয়েশা ফয়েজ
১৯৩০ সালের ২৩ মার্চ আয়েশা ফয়েজের জন্ম হয়। তার নানা বাড়ি বারহাট্টার কৈলাটি গ্রামে। তার বাবা শেখ আবুল হােসেন, মা খায়রুন নেসা। ১৯৪৪ সালের ফেব্রুয়ারির আট তারিখ তার বিয়ে। হয় ফয়জুর রহমানের সাথে। পুলিশ অফিসার স্বামীর সাথে সাথে তিনি তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে সিলেট, জগদল, পঞ্চগড়, রাঙামাটি, চট্টগ্রাম, বগুড়া, কুমিল্লা ও পিরােজপুরে ছিলেন। ১৯৭১ সালে পিরােজপুরে থাকাকালীন সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে তার স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁকে। একটি ভয়ংকর জীবনের মুখােমুখি হতে হয়। স্বাধীনতার পর তিনি তার ছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় সম্পূর্ণ অনিশ্চিত একটি জীবন শুরু করেন। যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাংলাদেশে সহায় সম্বলহীন এই জননী বুক আগলে তার ছেলেমেয়েদের রক্ষা করে মানুষ করেন। তাঁর ছয় ছেলেমেয়ে হুমায়ুন আহমেদ, সুফিয়া হায়দার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মমতাজ শহীদ, আহসান হাবীব ও রােখসানা আহমেদ সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে কর্মরত এবং প্রতিষ্ঠিত।