ভারত বিভাগের পরবর্তী সময়। অস্তিত্ব রক্ষা ও স্থিতির জন্যে দুই দেশেই চলছে তখন মানুষের লড়াই। এ উপন্যাসের কয়েকটি চরিত্রও এই তাড়িত মানুষ। এদের কেউ স্থায়ী, কেউ বিদ্রোহী কবির চুরুলিয়া থেকে আসা। এই গল্পের কথকও এসে নামে ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন। ঘোড়ার ক্ষুরের ধ্বনি কান ছুঁয়ে মরমে প্রতিধ্বনি তোলার সেই সূচনা। প্রতীকি সূচনা ‘ইতু বৌদির ঘরে’র। ঢাকা তখন নতুন দেশের প্রাদেশিক রাজধানী। বিস্ময়ের দরজাগুলি খুলে যেতে থাকে উত্তমপুরুষের। চুরুলিয়ার লেখক শেখ আবু রায়হান ওমর, বন্ধু-অন্তপ্রাণ হেদায়েত-উর রহমান ও উত্তমপুরুষ ঘোড়ার গাড়িতে ঘোরার চক্রে পড়ে একসময় আবিষ্কার করে প্রাচীন সেই বাড়ি। সুচিত্রা সেনের শ্বশুরালয় ‘সেন নিবাস’। ‘ইতু বৌদির ঘর’ উপন্যাসটির পটকেন্দ্র এই বাড়ি। মনোজগতের আলো-আঁধারি এবং মন বিনিময় এখানেই শুরু। উত্তমপুরুষ বুলবুল চৌধুরী-চরিত্রে তাই ভিন্ন ধারা পরিলক্ষিত। কারণ লেখক হয়ে ওঠার তীব্র আকাক্সক্ষায় তিনি গোপন করেননি নিজেকে। অবলোকন করেন নির্লিপ্ততায় লেখক শেখ আবুল রায়হান ওমরকে। কেন আত্মহননই তার জরুরি ছিল! পাশাপাশি দেখা হয় ‘সেন নিবাসে’র উত্তরসূরি দেবাশীষকে, যে ভালোবাসার মেয়ে মিতুয়ারী দাসকে নিয়ে পালাতে গিয়ে মাঝপথে পৌঁছে দেখে ‘ভুল-মানুষ’ উঠে এসেছে গাড়িতে। এ যে প্রেমিকার যমজ বোন ইতুয়ারী দাস। বদলে যেতে থাকে দেবাশীষ। তাই ‘সেন নিবাসের’র পুত্রবধূ হিসেবে ইতু স্বীকৃতি ও মর্যাদা পেলেও না-পাওয়ার হাহাকার নিয়ত দীর্ঘ হয়। সমাজপুরুষ ও পরমপুরুষ দ্বন্দ্ব তার মধ্যে জায়মান। তবু অবচেতন সে সাধন করতে চায় উত্তমপুরুষের হৃদয়। সরল স্বীকারোক্তিও অসামান্য কালো ওই বউটির কণ্ঠে, ‘পরজনমে তোমাকে চিনবো কেমনে বুলবুলদা?’ দেশে হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধ শুরু। বাংলাদেশ স্বাধীন করার ওই জীবনমরণ পর্বে যূথবদ্ধ মানুষের বিচ্ছিন্ন হওয়ার পালা। অনেক প্রশ্নেরই মীমাংসা হয়নি। চুরুলিয়ায় ফেলে আসা লেখকের মানসকন্যা আরতির মুখচ্ছবি বিস্মরণের পর্দায় কোনোদিনই ঢাকতে পারল না উত্তমপুরুষ। তাছাড়া দেবাশীষ, তার বোন অতসী কিংবা ইতুয়ারী দাসের ক্ষেত্রেও কী-ইবা সমাপন। মনোজগৎ বাস্তবতা। যুদ্ধ শেষে বিজয় এলো। কিন্তু কাউকে আর পাওয়া গেল না ‘সেন নিবাসে’। জীব-রহস্যের অনেক মীমাংসা যেমন কখনো মেলে না, যাপিতজীবন তেমনই এক জটিল সমীকরণ। মনোজগতের চিত্রার্পিত ‘ইতু বৌদির ঘর’ তাই হয়ে ওঠে সমীকরণ। মীমাংসায় সার্থক এবং ভিন্ন এক কৃত্য।
বুলবুল চৌধুরী
বুলবুল চৌধুরী (জন্ম: জানুয়ারি ১, ১৯১৯ - মৃত্যু: মে ১৭, ১৯৫৪) প্রখ্যাত বাঙালি নৃত্যশিল্পী। পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়ার চুনতি গ্রামে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাঁর সমান খ্যাতি ছিল। তার নাম অনুসারে বুলবুল ললিতকলা একাডেমী নামে বাংলাদেশের স্বনামধন্য সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র রয়েছে। পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিলো রশিদ আহমদ চৌধুরী। নৃত্যশিল্পের বাইরে তিনি লেখক হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। ১৯৪২ সালে তার উপন্যাস 'প্রাচী' প্রকাশিত হয়। বুলবুলের লেখা ছোটগল্প 'অনির্বাণ' রুশ ভাষায় অনূদিত হয়েছিল। তার অন্যান্য লেখার মধ্যে ছিলো - আরাকান ট্রাংক রোড, পাদপ্রদীপ।