“হাজার বছর ধরে” বইটির প্রথম দিকের কিছু কথাঃ মস্ত বড় অজগরের মতাে সড়কটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে। মােগলাই সড়ক।লােকে বলে, মােগল বাদশাহ আওরঙ্গজেবের হাতে ধরা পড়বার ভয়ে শাহ সুজা যখন আরাকান পালিয়ে যাচ্ছিলাে তখন যাবার পথে কয়েক হাজার মজুর খাটিয়ে তৈরি করে গিয়েছিলাে এই সড়ক। দু-পাশে তার অসংখ্য বটগাছ। অসংখ্য শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে সগর্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই দীর্ঘকাল ধরে। ওরা এই সড়কের চিরন্তন প্রহরী। কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রাম। চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা। মাঝে মাঝে ধানক্ষেত সরে গেছে দূরে। দু-ধারে শুধু অফুরন্ত জলাভূমি। অথৈ পানি। শেওলা আর বাদাবন ফাকে ফাকে মাথা দুলিয়ে নাচে অগুনতি শাপলা ফুল। ভাের হতে আশেপাশের গায়ের ছেলে-বুড়ােরা ছুটে আসে এখানে। একবুক পানিতে নেমে শাপলা তােলে ওরা। হৈ-হুল্লোড় আর মারামারি করে কুৎসিত গাল দেয় একে অন্যকে। বাজারে দর আছে শাপলার। এক আঁটি চার পয়সা করে। কিন্তু এমনও অনেকে এখানে শাপলা তুলতে আসে, বাজারে বিক্রি করে পয়সা রােজগার করা যাদের ইচ্ছে নয়। মন্তু আর টুনি ওদেরই দলে। ওরা আসে ধল-পহরের আগে, যখন পুব আকাশে শুকতারা ওঠে। তার ঈষৎ আলােয় পথ চিনে নিয়ে চুপিচুপি আসে ওরা। রাতের শিশিরে ভেজা ঘাসের বিছানা মাড়িয়ে ওরা আসে ধীরে ধীরে। টুনি ডাঙায় দাঁড়িয়ে থাকে। মন্তু নেমে যায় পানিতে। তারপর, অনেকগুলাে শাপলা তুলে নিয়ে, অন্য সবাই এসে পড়ার অনেক আগে সেখান থেকে সরে পড়ে ওরা। পরীর দীঘির পারে দুজনে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। শাপলার গায়ে লেগে থাকা আঁশগুলাে বেছে পরিষ্কার করে। মন্তু বলে, বুড়া যদি জানে তােমারে আমারে মাইরা ফালাইবাে। টুনি বলে, ইস, বুড়ার নাক কাইটা দিমু না। নাক কাইটলে বুড়া যদি মইরা যায়। মইরলে তাে বাঁচি। বলে ফিক করে হেসে দেয় টুনি। বলে, পাখির মতাে উইড়া আমি বাপের বাড়ি চইলা যামু। বলে আবার হাসে সে, সে হাসি আশ্চর্য এক সুর তুলে পরীর দীঘির চার পাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়। এ দীঘি এককালে এখানে ছিলাে না। আশেপাশের গায়ের ছেলে-বুড়ােদের প্রশ্ন করলে তারা মুখে-মুখে বলে দেয় এ দীঘির ইতিহাস। কেউ চোখে দেখেনি, সবাই শুনেছে। কেউ শুনেছে তার বাবার কাছ থেকে।
জহির রায়হান
জহির রায়হান : জন্ম ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট বর্তমান ফেনী জেলার মজুপুর গ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষা কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট ও আলিয়া মাদ্রাসায়। ফেনীর আমিরাবাদ হাই স্কুল থেকে প্রবেশিকা পাস করেন। তার আগেই কলকাতার বিখ্যাত নতুন সাহিত্য পত্রিকায় ‘ওদের জানিয়ে দাও শিরােনামে তার একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যােগ দিয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৫৩ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএসসি ও ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ সম্মান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রখ্যাত চিত্র পরিচালক জে এ কারদারের সহকারী হিসেবে। তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনাে আসেনি' মুক্তিলাভ করে ১৯৬১ সালে।
ছাত্রজীবনেই তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৪ সালে তার হাজার বছর ধরে উপন্যাসটির জন্য তিনি আদমজি পুরস্কার লাভ করেন। পাকিস্তানের প্রথম রঙিন ছবি ‘সঙ্গম' তাঁর হাত দিয়েই তৈরি হয়। ১৯৭০ সালে মুক্তিলাভ করে তাঁর পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া ছবিটি। এটি ছিল এদেশের প্রথম যথার্থ রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ ছবি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তৈরি করেন ‘স্টপ জেনােসাইড' ও ‘এ স্টেট ইজ বর্ন ছবি দুটো। এ সময় গঠিত বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী মুক্তি পরিষদ’ এর তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি বড় ভাই শহীদ সাংবাদিকঔপন্যাসিক শহীদুল্লা কায়সারকে খুঁজতে গিয়ে তিনি নিখোঁজ হন। সাহিত্যকর্মের জন্য জহির রায়হান বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৭২) ও স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯২) এবং চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় একুশে পদক লাভ করেন (১৯৭৭)।