ফ্ল্যাপের কিছু কথাঃ চলতি কথায় যাদের বলে বাউল বৈরাগী দরবেশ সাঁই কিংবা সহজিয়া উদাসীন তাদের কি সত্যিই জানি তেমন করে? দেগশো বছর আগে উইলসনা সাহেব আর অক্ষয়কুমার দত্ত এমনতর নানা উপাসক সম্প্রদায়কে শনাক্ত করে তাদের সংক্ষিপ্ত বৃত্তান্ত জানিয়েছিলেন। তারপরে কিন্তু এরা হারিয়ে গিয়েছিল গ্রামের গহনে- গৌণধর্ম বিষয়টাই যেন গৌণ হয়ে পড়েছিল বাঙালি বিদ্বৎসমাজে। সেই গভীর নির্জন পথে একাকী পায়ে হেঁটে, দু দুশক ধরে নদিয়া-মুর্শিদাবাদ-বীরভূম-বর্ধমান-কুষ্টিয়া-মেহেরপুরের গ্রামীণ পরিমণ্ডল ঢুঁড়ে, নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে নতুন ধারার লেখনীতে এবারে লেখক ধরেছেন সেই বিচিত্র ভুবনের অন্তর্গহন বাণী্ সারাদেশে ছড়ানো-ছিটানো বিচিত্র সব গৌণধর্ম আর তার সাধক-সাধিকা, রহস্যসংকুল তাদের দেহতত্ত্ব ও সাধনা, সংকেতিত ভাষার ব্যবহার, দ্ব্যর্থক গান আর জীবনযাপনের কবোষ্ণ বৃত্তান্ত বাংলাভাষায় আগে কখনও শোনা যায়নি। পুথিপড়া লোকসংস্কৃতিচর্চার আড়ালে, সমাজবিজ্ঞান ও সমাজ-নৃতত্ত্ববিদ্যার সমান্তরালে অন্তঃশীল রয়ে গেছে এক মায়াবি বিশ্ব। গ্রামে গ্রামে আর গানে গানে গাঁথা সেই লোকায়ত যাপনের আখ্যান যেন জাদু-বাস্তবের ঢঙে রূপ পেয়েছে এ-ইয়ের বিন্যস্ত ছটি অধ্যায়ে। উঠে এসেছে এমন সব মানুষ, েচেনা সমাজে যাদের কোনও আদল নেই। শোনা গেছে এমন সব গানের ভাষ্য ও বয়ান যা অপূর্বকল্পিত। ‘এক্ষণ’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশেই ‘গভীর নির্জন পথে’ বাঙালি পাঠকদের চমকিত করেছিল। বই আকারেও এক দশকের বেশি জনপ্রিয় এই রচনাধারা খুলে দিয়েছে বাংলার সমাজ সংস্কৃতিচর্চার এক নতুন পথ- বাংলা গদ্যশৈলীরও এক নবনিরীক্ষা।
সুধীর চক্রবর্তী
সুধীর চক্রবর্তীর জন্ম ১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। পৈতৃক ভিটা নদিয়া জেলার দিগনগর। ১৯৪২ সাল থেকে কৃষ্ণনগরের স্থায়ী বাসিন্দা। বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম.এ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচ. ডি। ১৯৯৪ সালে সরকারি কলেজের অধ্যাপনা থেকে অবসর নিয়ে এখন সর্বক্ষণের লেখক। নেশা: গান শােনা, গান গাওয়া আর গান নিয়ে লেখালেখি। পছন্দসই আর একটি কাজ হল ধ্রুবপদ’ নামের বার্ষিক সংকলন সম্পাদনা ও প্রকাশ করা। দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে লৌকিক গৌণধর্ম বিষয়ে সরেজমিন সন্ধানের কাজ চলছে। সাহেবধনী, বলরামী, কর্তাভজা ও লালনপন্থীদের সম্পর্কে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ। ভাষণ দেবার জন্য ১৯৯৯ সালে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন আমেরিকার টেক্সাসের অন্তর্গত আর্ভিং শহরে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ কুড়িটি—যার বিষয় সংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, লােকধর্ম, নিম্নবর্গের সংস্কৃতি, দেশজ শিল্পকলা, গ্রাম, মেলা ও মহােৎসব, মৃৎশিল্প, সাহিত্য এবং বাউল-ফকিরদের কথা। নিজস্ব ঢঙে লেখা আখ্যানমূলক বিচিত্র রচনা: ‘গভীর নির্জন পথে, ‘নির্বাস, সদর-মফস্বল’, ‘পঞ্চগ্রামের কড়চা ও ‘মাটি-পৃথিবীর টানে। পেয়েছেন শিরােমণি পুরস্কার (১৯৯৩), আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন পুরস্কার (১৯৯৫-৯৬), নরসিংদাস পুরস্কার (১৯৯৬)। ১৪০৮ বঙ্গাব্দের আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন ‘বাউল ফকির কথা’ বইয়ের জন্য।