আমাদের আসতে বলা হয়েছিল মধ্যরাতে। রাত বারোটায়। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবে ঠিক এগারোটায়, তারপর কারা কর্তৃপক্ষের নাকি কিছু আনুষ্ঠানিকতা থাকে, মৃতদেহের ডাক্তারি পরীক্ষা, নথি লেখা, সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি করা, গোসল দেওয়া, কাফনের কাপড় পরিয়ে লাশ কফিনবদ্ধ করা, সেসব কাজ শেষ করতে ঘণ্টাখানেক লাগবে। জেলখানার গেটের সামনে সময় যেন ভারী পাথর হয়ে অচল ঘড়ির মতো থমকে ছিল, আমার মনে হচ্ছিল এই রাত বুঝি আর কখনোই শেষ হবে না। আমি আর উমেদ আলী চাচা চুপচাপ গাড়ির লাইট নিভিয়ে ভেতরে বসে ছিলাম। চাচা চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা হেলিয়ে হয়তো ঝিমাচ্ছিলেন, আমি স্ট্রিট লাইটের বিবর্ণ আলোতে চোখ মেলে সামনে তাকিয়ে ছিলাম, কিন্তু দেখছিলাম না কিছুই, চালকবিহীন একটা ভ্যানগাড়ি রাস্তার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে বাঁকা হয়ে একা অসহায় ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে ছিল। আর তখনই কোত্থেকে উড়ে এসে একটা হলুদ ঠোঁটের ধবধবে সাদা সারস ডানা মেলে বসল ভ্যানের ওপর। তারপর ধ্যানী বুদ্ধের মতো স্থির একাগ্র হয়ে মূর্তির মতো বসে রইল, যেন নিশ্চিতভাবে অপেক্ষা করছে নিয়তিনির্ধারিত আমাদের জীবনের বিবিধ দুর্দশা আর আকাশ থেকে নক্ষত্রের ঝরে পড়ার শব্দ শোনার জন্য। আমাদের জীবনব্যাপী কত কত অপেক্ষা! কত কিছুর জন্য অপেক্ষা! অপেক্ষা কি এমন এক পাখি, যা কখনো উড়ে যায় না; এমন এক বাঁশি, যা কখনোই বাজে না, আকাশে তবু গোল নীল চাঁদ ওঠে, তারারা ঝিকমিক করে হাসে, ছায়াপথে ভেসে বেড়ায় ভবঘুরে পাখির ফেলে যাওয়া পালক, কেউ যখন চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়ে ফেলে, তখন মুহূর্তগুলো কি থমকে যায়? সমগ্র চরাচর কি একটি শক্ত শীতল মৃতদেহের জন্য গুনতে থাকে অপেক্ষার প্রহর?