সময় বিমূর্ত, প্রবহমান। বির্মূত সময়ের বস্তুগত চেহারা প্রতিবিম্বিত হয় কেবল ব্যক্তি-মানুষের ভেতর দিয়েই। ব্যক্তির ওপর দিয়েই সময় বয়ে যায়। অনুকূল বা প্রতিকূল সব রকম পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে ব্যক্তি-মানুষ জীবনযাপন করে। সময়ের চাপে বা তাপে ব্যক্তি-মানুষের ক্ষয়, বিকাশ বা বিনাশ ঘটে। সময়ের প্রবহমানতায় ব্যক্তির বিশ্বাস, মূল্যবোধ, চিন্তা-চেতনারও রূপান্তর হয়। ব্যক্তির বদলে যাওয়া এই স্বরূপের মধ্যে আমরা সময়ের বস্তুগত চেহারার বিচিত্র মুখশ্রী অবলোকন করতে পারি। ষাটের দশকে, বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত মানসের আর্থসামাজিক, রাজনীতির স্বপ্নময় আকাক্সক্ষা ও আশাভঙ্গের বেদনা, যাতনা নিয়ে রচিত হয়েছে শওকত আলীর সুবৃহৎ উপন্যাস দক্ষিণায়নের দিন (১৯৮৫) কুলায় কালস্রোত (১৯৮৬) এবং পুর্বরাত্রি পূর্বদিন (১৯৮৬)। শকত আলীর শিল্পসত্তার মৌলিক প্রবণতা হচ্ছে ইতিহাস ও সময়নিষ্ঠতা। সময়ের প্রবহমান অভিঘাতে ব্যক্তি-মানুষ কীভাবে পর্যুদুস্ত হয, সমাজ ও রাজনীতির দ্বন্দ্বময় সংঘাতে অস্তিত্ব সংকটে পড়ে, তারই স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে শওকত আলীর উপন্যাস ত্রয়ী বা ট্রিলজি।
শওকত আলী
বিগত চার দশক জুড়ে স্বদেশের অতীত, সমকাল নগর ও গ্রাম এবং মানব অস্তিত্বের সমগ্রতাকে সাহিত্যের ভাষ্যে ধারণ করার দূরূহ কাজে নিয়ােজিত রয়েছেন এদেশের শীর্ষ স্থানীয় লেখক শওকত আলী। তাঁর লেখায় মানুষ প্রকৃতি ও সময় মেশামেশি হয়ে থাকে। জীবনের জ্ঞান বাস্তবতাকে যেমন ধারণ করেন, তেমনি একই নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় ভবিষ্যত স্বপ্নের দিকেও তিনি দৃষ্টিপাত করেন। বড় মমতা দিয়ে তিনি গড়ে তােলেন তার গল্প ও উপন্যাসের কুশীলবাদ। তারা পাঠকের ভালবাসা আর সমবেদনা কেড়ে নেয় অতি সহজেই। ছােটগল্প রচনায় মৌলিক অবদানের জন্য বাংলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৬৮ তে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক উপন্যাস ‘যাত্রা’ রচনার জন্য বাংলাদেশ লেখক শিবির তাকে হুমায়ন কবির স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করেন। ১৯৭৭-এ শ্রেষ্ঠ উপন্যাস রচনার জন্য ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন দু’বার, ১৯৮৬তে ‘দক্ষিণায়নের দিন এবং ১৯৯২তে ‘উত্তরের খেপ' বাংলা উপন্যাস রচনায়। মৌলিক অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশ পদকে ভূষিত হন ১৯৯১-এ। এছাড়া সাহিত্য ক্ষেত্রে মৌলিক অবদানের জন্য তাকে অর্জিত গুহ পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯৮৪ তে। আলাওল পুরস্কার ১৯৮৯ এবং সৈয়দ গােলাম মরতুজা স্মৃতি পুরস্কার ১৯৯৮ তে তাকে দেওয়া হয়। শওকত আলীর জন্ম ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ এ পশ্চিম বঙ্গের ময়গঞ্জে, তাদের পুরুষানুক্রমিক বাস্তুভিটায়। তিনি শহীদ বুদ্ধিজীবি ডাক্তার খােরশেদ আলী সরকার ও মরহুমা সালেমা খাতুনের দ্বিতীয় পুত্র।