মানবসভ্যতা একসময় ছিল প্রস্তর যুগে। তখন মানুষের সব হাতিয়ার ছিল পাথর বা কাঠের তৈরি। এর পর একে একে এলো তাম্র যুগ ও লৌহ যুগ। যখন মানুষ তামা, লোহা ইত্যাদি পদার্থ ব্যবহার করে নানবিধ হাতিয়ার ও যন্ত্রাংশ তৈরি করতে শিখল; যখন কোনো নতুন পদার্থের ব্যবহার শেখার মাধ্যমে মানবসভ্যতার যুগ পরিবর্তন হয়, তখন দেখা যায় সেই সমাজের মানুষের জীবনমানে আমূল পরিবর্তন আসে। আজ থেকে হাজার বছর পরে কোনো নৃবিজ্ঞানী যদি আমাদের এই সময়ের দিকে পেছন ফিরে তাকায়, তাহলে হয়তো এই সময়কে শ্রেণিভুক্ত করবে সিলিকন যুগে। কারণ তামা, লোহার পরে এই সিলিকন নামক অর্ধপরিবাহী পদার্থের ব্যবহার আমাদের জনজীবনকে সম্পূর্ণরূপে বদলে দিয়েছে।
এ যুগে আমরা আকণ্ঠ ডুবে আছি ডিজিটাল প্রযুক্তিতে। প্রান্তিক চাষি থেকে সফল উদ্যোক্তা – মোবাইল ফোন ছাড়া এখন কেউ কি তার ব্যবসায় পরিচালনা করতে পারবে? সরকারি দপ্তর বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান – সবাই তাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম পরিচালনার জন্য ইমেইল, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার ও ক্লাউড সার্ভিস ইত্যাদি ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। এসব ডিজিটাল প্রযুক্তি, যেসব যন্ত্রাংশের ওপর নির্ভর করে বানানো, যেমন – ওয়াইফাই রাউটার, তথ্য সার্ভার, প্রোসেসর ইত্যাদির কেন্দ্রে থাকে সিলিকন মাইক্রোচিপ। এমনকি যেসব প্রযুক্তিকে ঠিক ডিজিটাল বলে মনে হয় না, যেমন – পেট্রোল বা ডিজেলচালিত গাড়ি, এগুলোও তাদের ইঞ্জিন পরিচালনার জন্য সিলিকন মাইক্রোচিপ ব্যবহার করে।
একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী বা ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ার যখন এসব ডিজিটাল প্রযুক্তি সংস্থাপন করে করেন, তখন তাঁকে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ভাষা ব্যবহার করে কিছু প্রোগ্রাম লিখতে হয়, যা এসব যন্ত্রাংশের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে। আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিয়ারিং অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষদ। তা হবেই-বা না কেন? বর্তমান যুগে যত বেশি দক্ষ পোগ্রামার ও ইঞ্জিনিয়ার একটি দেশের কর্মক্ষেত্রে থাকবে, সে দেশ ততই এগিয়ে যাবে। তবে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবনের মাধ্যমে মানবসভ্যতার যুগ পরিবর্তিত হলেও, সেই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী যে একইভাবে পরিবর্তিত হয়, তা কিন্তু নয়। যেমন এই বর্তমান সময়েও অ্যামাজনের গহিন অরণ্যে, কিংবা আন্দামানের সেন্টিনেল আইল্যান্ডে এমন বিচ্ছিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠী আছে, যারা আটকে আছে প্রস্তর যুগে। স্যাটেলাইট বা উড়োজাহাজ থেকে তাদের ছবি তুলে দেখা যায়, তাদের সব হাতিয়ার পাথরের বা কাঠ-খড়ের তৈরি। এরা দুর্গম অঞ্চলে থাকার কারণেই এত বছর টিকে গেছে। নইলে ইতিহাসে দেখা যায় পুরোনো যুগের সভ্যতা, তার চেয়ে নতুন যুগের সভ্যতার সংস্পর্শে এসে বিলুপ্ত হয়ে যায়।
অনেকেই হয়তো এটা ভেবে কিছুটা আস্বস্ত বোধ করবেন যে, আমরা অন্তত কোনো প্রাচীন যুগে আটকে নেই। পুরোদমে প্রবেশ করেছি ডিজিটাল যুগে। কিন্তু আসলেই কি তা-ই? তাম্র, লৌহ ইত্যাদির ব্যবহার করে হাতিয়ার প্রস্তুত করা যদি সেসব যুগকে নির্ধারণ করে, তাহলে এ যুগের সিলিকন ব্যবহার করে সিলিকন মাইক্রোচিপ বা নানা রকম ডিজিটাল বর্তনী ও যন্ত্রাংশ তৈরি করা হচ্ছে সিলিকন যুগের নির্ধারক। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, আমরা এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে শিখলেও, এগুলো বানানো এখনো বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে রয়ে গেছে। সিলিকন মাইক্রোচিপ বানানোর কোনো কারখানা আমাদের দেশে এখনো গড়ে ওঠেনি। বড়ো আকারের ইলেকট্রনিকস উৎপাদক প্রতিষ্ঠান এ দেশে যা আছে, তারা মূলত বিভিন্ন ডিজিটাল যন্ত্রাংশ অন্য দেশ থেকে আমদানি করে এনে এ দেশের সস্তা শ্রম ব্যবহার করে অ্যাসেম্বল করে। এ অবস্থার উত্তরণ তবেই সম্ভব যদি আমরা নতুন ডিজিটাল প্রযুক্তি নকশা ও প্রস্তুত করতে শিখি। অর্থাৎ এ দেশে একটি দক্ষ জনশক্তি গড়ে ওঠে, যারা শুধু প্রোগ্রামিং করতেই সক্ষম নয়, যে যন্ত্র তারা প্রোগ্রাম করছে সেটা তৈরি করতেও সক্ষম। সক্ষম নতুন নতুন উদ্ভাবনে। আর এসবের প্রথম ধাপ হচ্ছে ডিজিটাল লজিক ডিজাইন দক্ষতা অর্জন, যা এই বইয়ের আলোচ্য বিষয়।
প্রশ্ন আসতে পারে, এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে কত বিখ্যাত টেক্সট বই-ই তো আছে। তবু নতুন করে এই বই লেখা কেন? এ প্রশ্নের উত্তর দুটি। প্রথমত, বিখ্যাত সব বই বিদেশি ভাষায় লেখা। ফলে ভাষার বাধা বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর সামনে একটি বাড়তি অন্তরায় হিসেবে দেখা দেয়। আধুনিক প্রযুক্তিতে উন্নত অ-ইংরেজিভাষী দেশসমূহ, যেমন – জাপান, কোরিয়া, চায়না, রাশিয়া, জার্মানি বা ফ্রান্স – এরা সবাই স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত এসব বিষয় মাতৃভাষাতেই পাঠ করে। এটা শুধু জাত্যভিমান দেখানোর জন্য নয়। মাতৃভাষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার সুনির্দিষ্ট উপযোগিতা আছে, যা এসব জাতিগোষ্ঠী অনেক আগেই উপলব্ধি করেছে। এসব উপযোগিতা যেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকও পায়, সেটা এই বই লেখার অন্যতম উদ্দেশ্য। এ ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যটি হলো, বাহুল্য এড়িয়ে এই বিষয়ের মূল বিষয়বস্তু শেখার জন্য একটি বই পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া। প্রচলিত ইংরেজি টেক্সট বইগুলো কলেবরে বৃহৎ এবং পড়ার সময় হাজারটা বিষয়ের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখার বর্ণনায় অনেক সময় পাঠকের চোখ থেকে মূল ছবিটাই আড়াল হয়ে যায়। শ্রেণিকক্ষে একজন শিক্ষক এক্ষেত্রে পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করেন। বেশির ভাগ সময় দেখা যায় শিক্ষক, তিন মাসের সেমিস্টারে কভার করার জন্য প্রচলিত টেক্সট বই থেকে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয় নির্ধারণ করেন সিলেবাস হিসেবে। বাকি বিষয় বাদ রাখেন। লক্ষ থাকে শিক্ষার্থীদের মূল ভিত্তিটাকে শক্ত করা, যেন টেক্সট বইয়ের অন্য বিষয়গুলোও তারা প্রয়োজনমাফিক পড়ে শিখে নিতে পারে। কিন্তু অভিজ্ঞ শিক্ষক ছাড়া এসব টেক্সট বই পড়তে গেলে, অর্থাৎ সেলফ স্টাডি করতে গেলে সুবিশাল কলেবরের ভিড়ে একজন পাঠকের হারিয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে যায়। এই বইয়ে ইচ্ছে করেই শুধু ডিজিটাল লজিক ডিজাইনের সারবস্তুটুকু আলোচনা করা হয়েছে। একই সঙ্গে বইটি লেখা হয়েছে নিজে নিজে শেখার উপযুক্ত করে। এ ছাড়াও, স্নাতক পর্যায়ের সিলেবাসে যেসব বিষয় না পড়ালেই নয়, তেমন সব বিষয় এখানে কভার করা হয়েছে। সর্বাত্মক চেষ্টা করা করা হয়েছে বইটিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ রাখতে, যেন এটা পড়তে অন্য কোনো বইয়ের সহায়তা নিতে না হয় বা এটা পড়ার আগে অন্য কিছু পড়ে আসতে না হয়। এর ফলে এইচএসসি লেভেল পর্যন্ত বিজ্ঞান বিভাগে পড়েছে, এমন পাঠক এই বইটি সহজেই অনুসরণ করতে পারবে। এ ছাড়াও এইচএসসি লেভেলের অতি আগ্রহী শিক্ষার্থী, যারা বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস প্রোজেক্ট করতে ভালোবাসে, তারাও এই বইটি অনুসরণ করতে পারবে। সেলফ স্টাডি বা নিজে নিজে শেখা উৎসাহিত করতে বইয়ে বিভিন্ন উদাহরণ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত অনুশীলনী দেওয়া হয়েছে, যেগুলো সমাধান করে পাঠক নিজেকে যাচাই করতে পারবে। কোনো অধ্যায়ের বিষয়বস্তু বুঝলে একজন পাঠক সহজেই অনুশীলনীর প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে পারবে।
কোনো বিষয়কে অতি বিশদে বর্ণনা করলে অনেক সময় দেখা যায় বর্ণনার আতিশয্যে পাঠক খেই হারিয়ে ফেলে। ফলে বিষয়টা ভালোভাবে অনুধাবন করার বদলে, আরো বেশি ধাঁধার সৃষ্টি হয় পাঠকের মনে। এ অবস্থা এড়াতে, এ বইয়ের সব বিষয়বস্তুর বর্ণনা একই সঙ্গে সংক্ষিপ্ত ও প্রাঞ্জল রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। মূল গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন উদাহরণ ও অনুশীলনীর মাধ্যমে পাঠকের ভাবনাকে সঠিক দিকে পরিচালিত করার ওপরে। বইয়ের কলেবর সংক্ষিপ্ত রাখতে গিয়ে, ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনেক বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব হয়নি। আশা করি, বইটি পড়ে একবার ডিজিটাল লজিক ডিজাইনের সারবস্তুটি অনুধাবন করতে পারলে, অন্য সব বিষয় একজন পাঠক যেকোনো রেফারেন্স বই বা বিভিন্ন সিলিকন চিপ-এর ম্যানুয়াল বা তথ্যপুস্তিকা পড়েই শিখে নিতে পারবে। সিলিকন মাইক্রোচিপ তৈরি আধুনিক প্রযুক্তির একটি অতি উচ্চতর বিষয়। সেই উচ্চতর বিষয় শেখার পূর্বশর্ত হিসেবে একজন শিক্ষার্থীকে অবশ্যই ডিজিটাল লজিক ডিজাইন জানতে হবে। অর্থাৎ, বিষয়টি সিলিকনের জগতে প্রবেশের অবশ্যম্ভাবী প্রথম ধাপ। বাঙালি জাতিকে সিলিকন প্রযুক্তিতে স্বাবলম্বী করার পথে যদি কিছুটা অবদান এই বই রাখতে পারে, তাহলে আমার প্রচেষ্টা সার্থক।